ঢাকা ১৯শে জানুয়ারি, ২০২১ খ্রিস্টাব্দ | ৫ই মাঘ, ১৪২৭ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১১:১৫ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ৩০, ২০২০
নিজস্ব প্রতিবেদক
ভোর সাড়ে ৫টা। হঠাৎ বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে গোলাপগঞ্জ উপজেলার ফুলবাড়ি ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড। তড়িঘড়ি করে বাইরে এসে অনেকেই এমন শব্দের হেতু খুঁজছেন। কিন্তু ঘটনাস্থলের দূরে থাকা মানুষদের মধ্যে এর কোন দৃশ্য চোখে পড়েনি। শব্দের আন্দাজে এটি অনেক দূরে কোথাও হবে ভেবে আবারও কাঁথা কম্বলের নিচে আশ্রয় নিয়েছেন। তবে, খুব কাছে থেকেই একটি ধ্বংসযজ্ঞ দেখছে সদ্য ঘুম ভাঙা শিশু মেহেদী হাসান(৫)। বিকট শব্দের হেতু খুঁজতে অন্যদের মতো সেও দৌড়ে বের হয়। তার পেছনে বের হন বাবা-মা। চোখের সামনে আকাশ চুম্বি আগুনের লেলিহান শিখায় গোটা এলাকা লাল হয়ে গেছে। হঠাৎ ছেলের কথা মনে পড়ে মা মনতারা বেগমের। কুয়াশায় অন্ধকার চারদিক। হাসান কোথায় তা যেনো টার করা যাচ্ছে না। মায়ের সাথে খালা মনবালা বেগমও খুঁজছেন হাসানকে। হঠাৎ চোখে পড়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়া হাসানের নিথর দেহ। পায়ের উরু থেকে অজোর রক্ত ঝরছে। শুরু হয় চিৎকার আর কান্নার রুল। দৌড়ে কাছে আসেন বাবা মঞ্জু মিয়া। আশঙ্কাজনক অবস্থায় ছেলেকে নিয়ে ছুটে যান সিলেট এমএজি ওসমানী হাসপাতালে। ততক্ষণে অনেকটা দেরীও হয়ে গেছে তাদের। আর এই দেরির কারণ হলো গাড়ি। এখনও ভোরের আলো না ফোটাতে সড়কে তেমন কোনো গাড়ি নেই। তবে যা হবার তা হয়েই গেছে। চিকিৎসক হাসানকে মৃত ঘোষণা করেছেন। ছেলে মৃত্যুর খবরে মায়ের বুক ফাঁটা আর্তনাদে আকাশ-বাতাস ভারী হতে থাকে।
এই ঘটনা গোলাপগঞ্জ উপজেলার হেতিমগঞ্জ পশ্চিম বাজারের মোল্লাগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন সিলেট-জকিগঞ্জ রোডে। যেখানে এক মর্মান্তি সড়ক দুর্ঘটনায় তিন যাত্রী নিহত হন।
এদিকে, বিকট শব্দে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে গোটা এলাকায়। হাসানের বাব-মার মতো করে ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসেন মনতারা বেগম, মনবালা বেগম, নাছিমা বেগম, মঞ্জুর হোসেন খাঁন-সহ অনেকেই। আগুনের লেলিহান শিখা লক্ষ্য করে অনেক দূর থেকেও মানুষ জড়ো হতে থাকেন ঘটনা স্থলে। দমকল বাহিনীকে খবর দিলে তারাও ঘটনাস্থলে পৌছে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। ততক্ষণে সড়কেই ঝরে যায় তিনটি তরতাজা প্রাণ।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মঞ্জুর হোসেন খাঁন জানান, বিকট শব্দ শোনে আমি বাইরে বের হলে সড়কে আগুনের ফুলকি দেখতে পাই। আওয়াজের সাথে সাথে যেনো পুরো জমিন কেঁপে ওঠে। ধীরে ধীরে সামনে এগুতে থাকি। পরে আবিষ্কার করি ট্রাকের পেছনে একটি কার গাড়ির মতো। দুইটিতেই তখন আগুন ধাঁউ ধাঁউ করে জ্বলছে। চার দিকে তখন মানুষের শব্দ শোনা যাচ্ছে। এক এক করে অনেকেই তখন ঘটনাস্থলের দিকে এগিয়ে আসেন। দমকল বাহিনীকে খবর দিলে তারাও ঘটনা স্থলে উপস্থিত হয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা চালান।
তিনি বলেন, প্রথম দিকে আমরা গাড়ির ধ্বংসস্তুপে তিনটি বডি দেখতে পাই। তারা প্রায়ই ভস্মীভ‚ত। আর কোনো যাত্রী ছিল কী না সেটা জানার জন্য তোড়জোড় শুরু করি। তখন আধো আলোতে কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। একদিকে কুয়াশা, অপর দিকে ধোঁয়া। সব মিলিয়ে অবস্থা আন্দাজে অনেক বেগ পোহাতে হয়েছে। পরে এক কিশোরকে উদ্ধার করা হয়। সিলিন্ডার বিস্ফোরণের আগে আগেই সে কোনো রকম গাড়ি থেকে বের হলে প্রাণে রক্ষা পায়। এরপর জীবিত আরও দুই যাত্রীর সন্ধান পাই। তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয় এবং পরে তাদের স্বজনদের খবর দেওয়া হয়।
এদিকে, বেলা বাড়ার সাথে সাথে মানুষের উপস্থিতি বাড়তে থাকে। উৎসুক জনতার আফসোস আহাজারী রবে ভারী হতে থাকে চারপাশের পরিবেশ। সর্ববেশ বিকেল ৫টা পর্যন্ত ঘটনাস্থলকে ঘীরে ছিলো জনতা।
উল্লেখ্য,বুধবার ভোর সাড়ে ৫টায় ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে থাকা একটি সিমেন্ট বোঝাই ট্রাক (ঢাকা মেট্রো ট-২২৫২৪৭ ) কে চারখাইগামী একটি নোহা গাড়ি পেছন দিক থেকে ধাক্কা দিলে গাড়িটি ধুমড়ে মুচড়ে যায়। এসময় গাড়িতে থাকা তিন যাত্রী ঘটনাস্থলেই নিহত হন। অপর তিন যাত্রী কোনো রকম চেষ্টা করে বাইরে বেরিয়ে আসলে প্রাণে রক্ষা পান। পরক্ষণেই বিকট শব্দে নোহা গাড়ির সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে দুইটি গাড়িতেই আগুন লেগে যায়। নোহা গাড়ি ও গাড়ির ভেতরে থাকা নিহত যাত্রীরা ভস্মিভ‚ হন।
নিহত যাত্রীরা হলেন- বিয়ানীবাজারের চারখাই উপজেলার কসকট খাঁ বারইগ্রামের হাজী আব্দুল জলিলের ছেলে সুনাম মিয়া (২৪) ও একই এলাকার মৃত কুনু মিয়ার ছেলে রাজন (২২)। বাকি একজনের পরিচয় জানা যায়নি।
পরে বিকেল সাড়ে ৩টায় এদিকে বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে ঘটনাস্থলে পৌছে ক্রাইম সিন ইউনিট (সিআইডি)। তারা স্থানটি রেডমার্ক চিহ্নিত করে ভস্মীভ‚ত নোহা ও ট্রাক উদ্ধার করে তা জব্দ করেন।
সম্পাদক ও প্রকাশক : জে.এ কাজল খান
Design and developed by syltech