ঢাকা ২৩শে জানুয়ারি, ২০২১ খ্রিস্টাব্দ | ৯ই মাঘ, ১৪২৭ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৪:০৮ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৯, ২০২০
ফাইল ছবি
মো. ইসমাইল হুসাইন
প্রতিটি মানুষের জীবন জুড়ে রয়েছে পাওয়া না পাওয়া হারানোর অনেক ট্র্যাজেডি। শত কষ্ট বুকে চেপেও মানুষগুলোর মুখে হাসি দেখলে কৃতজ্ঞতায় বুক ভরে যায়। বিবেকের তাড়নায় বুকের গহিন থেকে তাদের জন্য আসে অসণিত শ্রদ্ধা আর অফুরান ভালোবাসা।
সকালে যখন শহুরে বাবুরা গরম চায়ে চুমুক দিয়ে পত্রিকা পড়েন, তখন তাদেরকে ছুটে যেতে হয় রিযিকের সন্ধানে। লক্ষ্য একটাই সন্তানের মুখে দু’মুঠো ভাত তুলে দিতে হবে। খুব বেশি চাওয়া নেই তাদের। বিশাল অট্টালিকা কিংবা অবকাশযাপন। একটু কম ভাড়ায় থাকা কলোনী কিংবা বস্তিকেই তারা নিজের আবাস বানিয়ে দিনযাপন করছে। তাদের খোঁজ রাখে না কেউ। রাখে যাদের বাসা বাড়িতে কাজের দরকার কেবল তারাই। বলছিলাম ভাগ্য বিড়ম্বিত হাওরপাড়ের মানুষের কথা।
সেদিন ভোরে কোর্ট পয়েন্ট হতে শহরতলীর মেজরটিলা আসতে মহাজনপট্টি পয়েন্টে একটি দৃশ্য দেখেই চোখ আটকে যায়। তাৎক্ষণিক মোটরবাইক থেকে নেমে পড়লাম। দেখলাম উড়া কোঁদাল নিয়ে কিছু মানুষ কাজের সন্ধানের জন্য অপেক্ষমান। এর মাঝে রয়েছেন অর্ধ-বয়স্ক মহিলারাও। তাদের ব্যাপারে কিছু জানার আগ্রহ থেকেই মূলত কাছে যাওয়া। আমি অনেকের সাথে কথা বলে কিছু মানুষের জীবন-জীবিকার গল্প নোট করলাম।
মখলিছুর রহমান সুনামগঞ্জ হাওরপাড়ের মানুষ। তার গ্রামের বাড়ি সদর উপজেলার ইসলামপুর গ্রামে। ২ ছেলে, ২ মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে তার সুখের সংসার। জমি ছিল কয়েক বিঘা। কিন্তু পর পর দুই বছর শিলা বৃষ্টি ও অকাল বন্যায় জমির ধান বিনষ্ট হওয়ায় জমি করা বাদ দিয়ে সন্তানদের নিয়ে সিলেটে এসেছেন। তাদের নিয়ে থাকেন শহরতলীর একটি কলোনীতে। বললেন দুজনের পড়ালেখা বাদ দিয়েছেন অর্থের অভাবে, আর দুটি বাচ্চা স্কুলে পড়ছে। শুধু তাদের পরীক্ষার সময় কেবলই বাড়িতে যান। বাকী সময় থাকেন শহরে। সকালে বের হন কাজের সন্ধানে। প্রতিদিন কাজ না জুটলেও প্রায় দিনই কাজ পান তিনি। দিনে সাড়ে তিনশ’ থেকে চারশ’ টাকা রোজি করে তিনি সংসার চালান।
কতদিন এভাবে চলবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন এই জবাবটা এখনই দিতে পারছি না। ভবিষ্যত নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত নয় তিনি, বললেন বর্তমানে বেঁচে থাকার সংগ্রামে বিজয়ী হওয়াই তার লক্ষ্য।
নুর রহমান। বাড়ি হবিগঞ্জে। ২ মেয়ে, ১ ছেলে ও স্ত্রীকে গ্রামের বাড়ী নবীগঞ্জ উপজেলার লাখাই গ্রামে রেখে তিনি একা এসেছেন শহরে। কাজ করে যা রোজি করেন তা সংসারে পাঠান। আর এভাবেই চলছে তার সংসার। তিনটি সন্তানই লেখাপড়া করছে তাই তাদের শহরে নিয়ে আসেননি বলে জানান সব হারিয়ে নিঃশ্ব হয়ে শহরে আসা এক সময়ের সফল এই কৃষক।
সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার তেরগাউয়ের কৃষক নয়ন মিয়া। এসেছেন কাজের সন্ধানে সিলেটে। বাড়িতে এক সন্তান, স্ত্রী ও মা’কে রেখে তিনি শহরে এসেছেন। শহরে প্রতিদিন গর্ত খেটে রোজি করে সংসারের হাতে টাকা তুলে দেয়াতেই তিনি এখন স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। পরিবারের সদস্যদের মুখে হাসি দেখলেই সব দুঃখ তার দুর হয়ে যায় এমনটাই বক্তব্য এই শ্রমিকের।
অর্ধবয়স্কা নারী জাহানারা বেগম থাকেন নগরের চৌকিদেখীতে। তবে তার গ্রামের ঠিকানা দিতে আগ্রহী নন। তিনিও এসেছেন কাজের সন্ধানে। তার সংসার নিয়েও আছে অনেক ট্র্যাজেডি। বলতে চান না কিছুই। তবে তার অশ্রæসজল চোখ বলে দিয়েছে তিনিও ভাগ্য বিড়ম্বিত হয়ে আজ রোজির সন্ধানে পুরুষের সাথে সমানভাবে কাজে যোগ দিয়েছেন।
তিনি বলেন, কষ্ট সয়ে গেছি তাই এখন তার কষ্ট বলে মনে হয় না। সারাদিন কাজ করে মালিকের কাছ থেকে যখন নগদ টাকা হাতে পান তাতেই যেন আকাশের চাঁদ হাতে আসার উপক্রম। তবে তিনি প্রতিদিন কাজে আসেন না। একদিন করলে দুইদিন বসে থাকেন বলেও জানান।
ভাগ্য বিড়ম্বিত এইসব মানুষের জীবনের বাস্তব গল্প শুনে নিজের অজান্তেই চোখের কোনে জল জমে গেলো। অতঃপর পাশের একটি টং দোকান থেকে চা আর বনরুটি দিয়ে ১০ জনকে আপ্যায়ন করে বিদায় নিয়ে আসলাম। আর চোখের সামনে যেন ভেসে উঠতে থাকলো তাদের জীবন সংগ্রামের না দেখা অধ্যায়গুলো। কামনা করলাম তাদের সুন্দর আগামীর জন্য। জীবনের অন্ধকারময় রাতগুলো কেটে তাদের জীবনে যেন শীঘ্রই ওঠে সফলতার সোনালী সূর্য। অতীতের দুঃখ ভুলে এসব মানুষগুলো যেন সামনে পথ চলে সফলতার সাথে।
সম্পাদক ও প্রকাশক : জে.এ কাজল খান
Design and developed by syltech