নিশিগন্ধা ফুল : মিষ্টি সৌরভে মনে হয় যেন নিঃশব্দ রাতের সুগন্ধী চিঠি

প্রকাশিত: ৮:০৯ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ২৮, ২০২৫

নিশিগন্ধা ফুল : মিষ্টি সৌরভে মনে হয় যেন নিঃশব্দ রাতের সুগন্ধী চিঠি

সুয়েব রানা, জৈন্তাপুর
রাত নেমে এলে শহর কিংবা গ্রামের আঙিনায় বাতাসে ভেসে আসে এক অপূর্ব ঘ্রাণ। কোথা থেকে আসে এই মিষ্টি সুবাস? খুঁজলে দেখা যাবে, নিঃশব্দে দোল খাচ্ছে একরাশ ছোট ছোট সাদা ফুল-নিশিগন্ধা।
নিশিগন্ধা (Cestrum nocturnum), যা বাংলায় ‘নিশিগন্ধা’ বা ‘নাইট জেসমিন’ নামে পরিচিত বিশেষ এক ফুল। যা দিনের আলোয় অনেকটাই নিরীহ থাকে, কিন্তু সন্ধ্যা নামতেই চারদিকে ছড়িয়ে দেয় গভীর এক সুবাস। অনেকে একে ‘রজনীগন্ধা’ বললেও, প্রকৃতপক্ষে রজনীগন্ধা ভিন্ন একটি ফুল। নিশিগন্ধা নিজের স্বতন্ত্র সৌরভ ও সৌন্দর্যে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে আমাদের পরিবেশে।
নিশিগন্ধার উৎপত্তি মূলত ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ। তবে বর্তমানে বিশ্বের বহু উষ্ণ ও উপউষ্ণ অঞ্চলের মতো বাংলাদেশেও এটি জনপ্রিয়ভাবে জন্মে। দেশের শহর, গ্রাম, শহরতলী- সব জায়গাতেই সন্ধ্যার পর বাতাসে নিশিগন্ধার উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। সহজ পরিচর্যা ও দ্রুত বৃদ্ধির জন্য বাগানপ্রেমীরা এর প্রতি আকৃষ্ট হন।
নিশিগন্ধা গাছ সাধারণত ৪ থেকে ৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। গাছের পাতাগুলি সরু ও চকচকে সবুজ রঙের। ফুলগুলো ছোট, সরু নলাকৃতি ও সাদা বর্ণের হয়, যা গুচ্ছাকারে ফুটে থাকে। তবে ফুলের মূল আকর্ষণ এর সৌরভ। সন্ধ্যার পর থেকেই ফুলের ঘ্রাণ তীব্র হয়ে ওঠে, যা ভোর পর্যন্ত স্থায়ী থাকে। দিনের বেলায় ফুলগুলি অপেক্ষাকৃত কম সুবাসিত থাকে।
গ্রীষ্মকাল ও বর্ষাকাল হচ্ছে নিশিগন্ধার প্রধান ফুল ফোটার ঋতু। তবে কিছু ক্ষেত্রে সারা বছরই গাছে অল্প বিস্তর ফুল দেখা যেতে পারে। বাড়ির বাগান, ছাদ বাগান কিংবা খোলা উঠানে এ গাছ চমৎকার মানিয়ে নেয়।
নিশিগন্ধা গাছ রোদ ও আধা ছায়াযুক্ত জায়গায় ভালো জন্মে। পানি নিষ্কাশন সুবিধাযুক্ত দোঁআশ বা বেলে দোঁআশ মাটি এ গাছের জন্য উত্তম। গাছের গোড়ায় যেন পানি জমে না থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখা প্রয়োজন। দ্রুত বৃদ্ধির জন্য মাঝে মাঝে ছাঁটাই করলে গাছটি আরও ঘন ও ফুলে ভরা হয়। নিয়মিত জলসেচ ও মাঝে মাঝে জৈব সার প্রয়োগ করলে গাছটি সুস্থ থাকে এবং আরও বেশি ফুল ফোটায়।
যদিও নিশিগন্ধা একটি সৌন্দর্যময় ও সুবাসিত উদ্ভিদ, তথাপি এর কিছু সতর্কতা রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, গাছের ফল এবং কিছু অংশ সামান্য বিষাক্ত হতে পারে। বিশেষ করে শিশু ও পোষা প্রাণীদের যেন গাছের কাছে যেতে না দেওয়া হয়, সে বিষয়ে সচেতন থাকা উচিত।
কিছু ক্ষেত্রে নিশিগন্ধার তীব্র ঘ্রাণ অ্যালার্জি বা শ্বাসকষ্টের সমস্যায় ভোগা ব্যক্তিদের জন্য অস্বস্তির কারণ হতে পারে। তাই বাসার চারপাশে এ গাছ লাগানোর আগে এ বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়াও গুরুত্বপূর্ণ।
মানুষের জীবনে নিশিগন্ধার প্রভাব :
শুধু গন্ধের জন্য নয়, নিশিগন্ধা মানুষের মনে আবেগও ছড়িয়ে দেয়। সন্ধ্যার পর যখন গোটা শহর নীরবতায় ডুবে থাকে, নিশিগন্ধার মিষ্টি সুবাস সেই নীরবতা ভেঙে এক অনির্বচনীয় প্রশান্তি এনে দেয়। গ্রামীণ বাড়ির উঠান থেকে শুরু করে শহরের ব্যালকনি পর্যন্ত, নিশিগন্ধার সুবাস যেন চুপিসারে জানান দেয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অতুলনীয় শক্তি।
অনেক বাড়িতে, মন্দিরে বা অনুষ্ঠানে নিশিগন্ধার ফুল সাজানোর কাজেও ব্যবহৃত হয়, যদিও ফুলটি তুলনামূলকভাবে কোমল হওয়ায় বেশি ব্যবহৃত হয় না। তবু এর সুবাসই যথেষ্ট মন জয় করার জন্য।
নিশিগন্ধা আমাদের জীবনের এক নীরব সঙ্গী। এর মিষ্টি ঘ্রাণে যেমন মিশে থাকে গভীর রাতের প্রশান্তি, তেমনি ছড়িয়ে পড়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য। যত দিন যাবে, রাতের আকাশের নিচে নিশিগন্ধার এই মায়াময় সুবাস মানুষের হৃদয়ে চিরকাল বেঁচে থাকবে।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

সর্বশেষ ২৪ খবর