কারবালার হৃদয় বিদারক ঘটনা

প্রকাশিত: ৮:০৫ অপরাহ্ণ, জুলাই ৬, ২০২৫

কারবালার হৃদয় বিদারক ঘটনা

মুহাম্মদ আবদুল হামিদ

কারবালার ঘটনা মুসলিম ইতিহাসে একটি শোকাবহ ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কারবালার যুদ্ধ মূলত সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকার শিক্ষা দেয়। এটি অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার এবং আত্মত্যাগের আদর্শ স্থাপন করে। ইমাম হোসাইন (রা.) এবং তার সঙ্গীরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে জীবন উৎসর্গ করে গেছেন, যা আজও মানবজাতির জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। তিনি ইয়াজিদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। চরম প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও তাঁর বিশ্বাস থেকে বিচ্যুত হননি। তাঁর এই আত্মত্যাগ অত্যাচারীদের মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছিল। ইসলামের ইতিহাসে এটি একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।

হযরত মুয়াবিয়া (রা.) ইন্তেকালের পূর্বে তাঁরই পুত্র ইয়াজিদকে উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করেছিলেন। অতঃপর ৬০ হিজরি সালে পিতার মৃত্যুর পর ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়া নিজেকে মুসলিম বিশ্বের খলিফা হিসেবে ঘোষণা করে ক্ষমতায় আরোহন করেন। কিন্তু ইয়াজিদ মুসলিম বিশ্বের খলিফা হওয়ার যোগ্য ছিলেন না। কেননা তিনি ছিলেন ভোগ-বিলাসে মত্ত। যৌবনকালে লাম্পট্যপনা আর মদ্যপায়ীদের সাথে তাঁর সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। এমনকি তিনি নিষিদ্ধ মধ্যপানকে বৈধ ঘোষণার পাশাপাশি একই সঙ্গে দুই সহোদরকে বিবাহ করাকেও বৈধ ঘোষণা করেছিলেন। শাসক হিসেবেও তিনি ছিলেন স্বৈরাচারী ও অত্যাচারী। এসব কারণে তৎকালীন কুরাইশ ও হেজাযের অভিজাতগণসহ হজরত হোসাইন (রা.), আব্দুল্লাহ বিন যুবাইর (রা.), আব্দুল্লাহ বিন উমর (রা.), আব্দুর রহমান বিন আবু বকর (রা.) প্রমুখগণ শাসক হিসেবে ইয়াজিদকে মান্য করতে অস্বীকৃতি জানান এবং মদিনা ছেড়ে মক্কায় চলে আসেন।

হযরত হোসাইন (রা.) মক্কায় পৌঁছে শে’আবে আবু তালিবে অবস্থান নেন। এসময় কুফার নেতাদের পক্ষ থেকে হুসাইন (রা.) এর প্রতি অনেকগুলো পত্র প্রেরণ করা হয়। এতে বলা হয়, ‘আমরা এখন ইমাম বিহীন। আপনি যদি অনুগ্রহপূর্বক আমাদের এখানে আগমণ করেন তাহলে আপনার পক্ষাবলম্বনে আমরা ন্যায়ের পথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যাবো।’

তাদের সীমাহীন পীড়াপীড়িতে হযরত হুসাইন (রা.) মুসলিম বিন আকীলকে কুফার পরিস্থিতি জানার জন্য প্রেরণ করেন। তিনি সেখানে পৌঁছিলে ইরাকবাসী তাকে ভুল তথ্য দেয়। সেই মর্মে তিনি সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে হুসাইন (রা.) কে অবগত করে বলেন, ‘আপনি নিঃশংকিতে শুভাগমণ করেন। ইরাকবাসী আপনারই শভাকঙ্খী এবং সহযোগী।’ অতঃপর ৬০ হিজরি ৮ জিলহজ্ব পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধনসহ সবাইকে নিয়ে কুফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।

ছালাবিয়া নামক স্থানে পৌঁছিলে মুসলিম বিন আকীলের শাহাদাতের সংবাদ পেলেন। ইয়াজিদ বাহিনী তাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। জাবালা নামক স্থানে পৌঁছিলে তাঁর দুধভাই আব্দুল্লাহ বিন বাকতার এর শাহাদাতের দুঃসংবাদ পেলেন। এসব দুঃসংবাদ পাওয়ার মাধ্যমে কুফার পরিস্থিতি বুঝতে আর কোনো সন্দেহ রইলো না। তাই তিনি তাঁর সঙ্গী সাথীগণকে ডেকে বললেন, “কুফাবাসী আমাদের সাথে প্রতারণা করেছে। তাদের থেকে সহযোগীতা পাওয়ার কোনো আশ্বাস নেই। সুতরাং আমাদের যেসকল সাথীগণ ফিরে যেতে ইচ্ছুক তারা স্বেচ্ছায় চলে যেতে পারেন।” এ ঘোষণা শোনার পর অনেকেই ফিরে গেলেন। শুধুমাত্র হুসাইন (রা.) এর বংশের লোকজন ও বিশেষ কিছু ত্যাগী সাথী ও সঙ্গীগণ সাথে রয়ে গেলেন।

এদিকে হুসাইন (রা.) এর আগমণের সংবাদ পেয়ে মদিনা থেকে ইরাক আসার সকল পথে অবরোধ দিয়ে রাখেন যিয়াদ। এর দায়িত্বে থাকেন হুর বিন ইয়াজিদ। তিনি এক হাজার সৈন্য নিয়ে হুসাইন (রা.) এর অনুসন্ধানে বের হন। হাশাম নামক স্থানে পৌঁছার পর হুসাইন (রা.) এর সাথে হুর বিন ইয়াজিদের সাক্ষাৎ হয়। এবং হুর বলেন, আমরা আপনাকে বন্ধী করে কুফায় ইনবে যিয়াদের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশিত হয়েছি। একথা শোনার পর হুসাইন (রা.) বলেন, “তা কখনও সম্ভব নয়।” তিনি তাঁর সাথীগণকে ফিরে যেতে আদেশ করেন। কিন্তু হুর তাকে ফিরে যেতে দেয়নি। হিজায ও ইরাকের মধ্যবর্তী কোনো পথ অবলম্বন করতে বলে। একথা শোনে হুসাইন (রা.) নিনোয়ার পথ অবলম্বন করেন। হুরও তার বাহিনী নিয়ে পেঁছনে পেঁছনে আসতে থাকে। এভাবে ২ মহররম ৬১ হিজরি হুসাইন (রা.) ও তাঁর সাথীগণ কারবালা নামক স্থানে পৌঁছিলে হুর তার পথ রুদ্ধ করে ফেলেন আর বলতে থাকেন আপনাকে আর অগ্রসর হতে দেয়া হবে না। এখানেই অবস্থান করুন।

কারবালায় অবস্থান করার ২য় দিন উমর বিন সাদ চার হাজার সৈন্য নিয়ে উপস্থিত হয়ে হুসাইন (রা.) কে জিজ্ঞেস করেন, আপনি এখানে কেন এসেছেন? হযরত হুসাইন (রাঃ) উত্তরে বলেন, “কুফাবাসীর আমন্ত্রণে এখানে এসেছি। তবে আমার মনে হচ্ছে তারা আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। সুতরাং আমাকে যেতে দিন। আমি মদীনা চলে যাব। কিন্তু উমর বিন সাদকে ইয়াজিদ নির্দেশ দিয়েছিল যে, হযরত হুসাইন (রাঃ) ইয়াজিদের আনুগত্য মেনে নিতে বাধ্য করাতে হবে। অন্যথায় তাঁর পানি বন্ধ করে দিতে হবে।

হুসাইন (রা.) তা মেনে নেননি। অবশেষে ৭ই মুহাররম উমর বিন সা’দ ফুরাত নদের পানি বন্ধ করে দেন এবং নদীর তীরে পাঁচশত অশ্বারোহী দ্বারা পাহারা স্থাপন করেন।

একপর্যায়ে হযরত হুসাইন (রা.) ও উমর বিন সা’দ উভয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ খোঁজছিলেন। কিন্তু তাদের পরস্পরের মতবিনিময়ের খবর ইবনে যিয়াদের নিকট পৌঁছে যায়। এতে সে ক্ষিপ্ত হয়ে কঠোর ভাষায় যুদ্ধ করে হুসাইন (রা.)-এর পতন ঘটাতে বলে। ইবনে যিয়াদের এই কঠোর ধমক শোনে ৯ই মুহাররম বিকালে ইবনে সা’দ ভগ্ন হৃদয়ে সৈন্যদলকে প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দেন।

অবশেষে ১০ই মুহররম আশুরার দিন হযরত হুসাইন (রা.) ফজরের নামায শেষে তাঁর মহৎ ও দুঃসাহসিক সাথীগণকে নিয়ে রণক্ষেত্রে নেমে এলেন। ডানে জুহায়র বিন কায়ন, বামে হাবীব বিন মুজাহিরকে নিযুক্ত করেন। আব্বাস বিন আলীকে পতাকা দেয়া হলো। এক পর্যায়ে কুফাবাসীর পক্ষ থেকে একটি তীর নিক্ষেপ হওয়ার মধ্য দিয়ে যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে যায়। সর্বপ্রথম মল্ল যুদ্ধ আরম্ভ হয়। এতে কুফাবাসীর অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিছুক্ষণ পর শুরু হয় বিক্ষিপ্ত যুদ্ধ। স্বল্প সংখ্যক আহলে বাইত ভীরু মনে কুফাবাসীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। বীরবিক্রম হুসাইনী সৈন্যদল শত্রু পক্ষের সৈন্যদলকে ছত্রভঙ্গ করে দিচ্ছিলেন। হুসাইনী বাহিনী সংখ্যায় কম হলেও তারা ছিলেন সত্যের পথে সাহসী সৈনিক। তরা কখনই পিছপা হননি। একে একে জান্নাতের মেহমান হয়ে যাচ্ছিলেন। আহলে বাইতের আলী আকবর বিন হুহসাইন, আব্দুল্লাহ বিন মুসলিম বিন আকীল, আদী বিন আব্দুল্লাহ বিন জাফর, আব্দুর রহমান বিন আকীল, মুহাম্মদ বিন আকীল, কাসেম বিন হুসাইন বিন আলী, আবুবকর হুসাইন বিন আলী শাহাদাতবরণ করেন।

একপর্যায়ে হযরত হুসাইন (রা.) যখমে ক্ষত-বিক্ষত ও তৃষ্ণায় ক্লান্ত হয়ে বসে পড়েন। এ মুহূর্তেই হুসাইন বিন নুমাইর নামক এক শত্রু তাঁর উপর একটি তীর ছুঁড়ে মারল। যা তাঁর গলায় বিদ্ধ হলো। তীব্র আঘাতে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ফুরাত নদের দিকে গড়িয়ে যেতে লাগলেন। ইতোমধ্যে শত্রুদল ও চার দিকে ঘিরে ফেলে। ওয়ারআহ বিন শারীক তামীমী তরবারি দ্বারা গুরুতর আঘাত করে, সেনানা বিন আনাস নাখঈ বর্শা মেরে তাঁকে মাটিতে ফেলে তরবারি দ্বারা তাঁর মাথা দ্বিখন্ডিত করে শহীদ করে ফেলে। শহীদ হবার পর তাঁর শরীরে দেখা যায়, ৩৩টি বর্শার আঘাত, ৩০টি তরবারির আঘাত এবং তীরের আঘাতে শরীর ঝাজরা হয়ে গিয়েছিল।

৬১ হিজরী ১০ই মুহাররম শুক্রবার এ হৃদয়বিদারক ও প্রলয়ংকরী ঘটনা সংঘটিত হয়। পরদিন নামাযে জানাযা আদায় করে শহীদগণের লাশ এ মাঠেই দাফন করা হয়। হযরত সাইয়্যেদুশ শুহাদা ও অন্যান্য শহীদগণের মাথা যেহেতু শত্রুদল সাথে নিয়েছিলো, তাই মাথা ছাড়া দেহ দাফন করা হয়। এ ঘটনায় হুসাইন (রা.) ও তার পরিবার-পরিজনসহ ৭২ জন আহলে বাইত শাহাদাতবরণ করেছিলেন। (তথ্যসূত্র : খেলাফতে বানু ইমাইয়া)

এ ঘটনায় যদিও ইয়াজিদের সেনাবাহিনী যুদ্ধের ময়দানে জয়ী হয়েছিল। তথাপিও মুমিনের হৃদয় রাজ্যে হজরত হোসাইন (রা.) বিজয়ের মর্যাদায় ভূষিত ও অধিষ্ঠিত রয়েছেন। কেননা এ সংগ্রাম সত্য এবং মিথ্যার দ্বন্দ্বের অবসান ঘটানোর সংগ্রাম। হযরত হুসাইন (রা.) অসত্য ও অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য সপরিবারে শাহাদাতবরণ করেছেন। ইসলামের সুমহান আদর্শকে সমুন্নত রাখার জন্য তাঁর এ আত্মত্যাগ ইতিহাসে সমুজ্জ্বল হয়ে আছে। তিনি সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলিম উম্মাহর জন্য এক উজ্জ্বল ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

লেখক : শিক্ষক ও প্রবন্ধকার।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

সর্বশেষ ২৪ খবর