সিলেট বিভাগে দেড় মাসে স্বজনদের হাতে ২০ খুন

প্রকাশিত: ৬:১৭ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ১৬, ২০২৫

সিলেট বিভাগে দেড় মাসে স্বজনদের হাতে ২০ খুন

বিজয়ের কণ্ঠ ডেস্ক
সম্পর্কে বিশ্বাসের ঘাটতি, পরকিয়া কিংবা তুচ্ছ স্বার্থের দ্বন্দ্বে স্বামী কেড়ে নিচ্ছে স্ত্রীর প্রাণ। কিংবা পরকিয়া প্রেমিককে সাথে নিয়ে স্বামীর হন্তারক হয়ে ওঠছে স্ত্রী। সম্পত্তি নিয়ে পিতা-পুত্রের দ্বন্দ্ব, ভাইয়ে-ভাইয়ে হানাহানি যেন নিত্যদিনের ঘটনা। আর তুচ্ছ এসব ঘটনায় সিলেটে স্বজনরা হয়ে ওঠছেন ‘ঘাতক’। সামান্য স্বার্থের কারণে একজন কেড়ে নিচ্ছেন অন্যজনের প্রাণ।

রবিবার এমন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সিলেটের অনলাইন গণমাধ্যম সিলেট ভিউ। তাদের হিসাবে গত দেড় মাসে সিলেটে স্বজনদের হাতে খুনোখুনির এমন ঘটনা ঘটেছে অন্তত ২০টি। সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হওয়া এবং দিন দিন মানুষের মধ্যে স্বেচ্ছাচারি মনোভাব তৈরি হওয়ায় এমন ঘটনার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে মন্তব্য করছেন সমাজবিজ্ঞানীরা।

গত ৯ নভেম্বর মাধবপুর উপজেলার সম্পদপুর গ্রাম থেকে দুই সন্তানের জননী সানজিদা আক্তার নিপার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। সানজিদার বাবার অভিযোগ, স্বামী রফিকুল ইসলাম গোপনে দ্বিতীয় বিয়ে করার পর থেকে সানজিদার উপর শুরু হয় শারীরিক নির্যাতন। বাবার দাবি, রফিকুল ও তার পরিবারের সদস্যরা পরিকল্পিতভাবে সানজিদাকে খুন করেছে।

গত ৩ নভেম্বর একই উপজেলার করড়া গ্রামের রাজন মিয়া স্ত্রী শাপলা আক্তারকে হত্যা করে লাশ বালুচাপা দিয়ে রাখেন। পরদিন আদালতে গিয়ে তিনি হত্যার দায় স্বীকার করেন। তার দাবি, স্ত্রী পরকিয়ায় লিপ্ত হওয়ায় তিনি খুন করেছেন।

ছাতকে ‘সৎদেবর’র সাথে পরকিয়ায় লিপ্ত হয়ে স্বামীকে খুন করার অভিযোগ ওঠেছে রানু বেগম নামের এক গৃহবধূর বিরুদ্ধে। ৭ নভেম্বর ওই গৃহবধূকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র‌্যাব জানায়, স্বামী জিয়াউর রহমানের সৎভাই বাবুল মিয়ার সাথে রানু বেগমের পরকিয়ার সম্পর্ক ছিল। বাবুল মিয়াকে সাথে নিয়ে স্বামীকে খুন করে বাড়ির পাশের একটি খালে বস্তাবন্দি করে লাশ ফেলে দেয়া হয়।

গত ৩১ অক্টোবর দক্ষিণ সুরমার তেলিরাইস্থ গ্রামের বাড়ির ছাদ থেকে উদ্ধার করা হয় উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবদুর রাজ্জাকের ক্ষতবিক্ষত লাশ। পরিবার ঘটনাটি আত্মহত্যা বলে দাবি করে অপমৃত্যু মামলা করতে চাইলে পুলশ বাদি হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করে। ওই মামলায় তার একমাত্র ছেলে আসাদ আহমদকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশের ধারণা পারিবারিক বিরোধের জের ধরে স্বজনদের হাতেই খুন হয়েছেন আবদুর রাজ্জাক।

গত ২৭ অক্টোবর নবীগঞ্জের কুড়িশাইল গ্রামে স্বামী পরিত্যক্তা মেয়েকে বটি দিয়ে আঘাত করে খুন করেছেন বাবা। পূর্ণিমা রানী দাশ নামের ওই স্বামী পরিত্যক্তা তরুণী এক তরুণের সাথে ঢাকায় পালিয়ে গিয়েছিলেন। কয়েকদিন পর বাড়ি ফিরে আসলে এলাকার লোকজন নানা কটুক্তি করতে থাকেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বাবা মতিলাল দাশ বটি দিয়ে আঘাত করে মেয়েকে খুন করেন।

১৭ অক্টোবর দোয়ারাবাজার উপজেলার রাঙ্গারচর এলাকা থেকে ফারুক আহমদ নামের এক মধ্যপ্রাচ্য ফেরত প্রবাসীকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে তিনি জানিয়েছেন, পরকিয়া সন্দেহে তিনি ১৪ অক্টোবর বিকেলে সিলেটের লাক্কাতুড়া বাগানের একটি জঙ্গলে নিয়ে তার স্ত্রী রাবেয়া বেগমকে খুন করে লাশ ফেলে আসেন।

৬ অক্টোবর সুনামগঞ্জে আদালত প্রাঙ্গনে স্বামী আখতার হোসেনের ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারান স্ত্রী শরিফা আক্তার। তিনি ধর্মপাশা উপজেলার কান্দাপাড়া গ্রামের হেকিম মির্জার মেয়ে। ৪ অক্টোবর গোলাপগঞ্জ উপজেলার ইসলামপুর গ্রামে স্বামী রেজাউল করিমের হাতে খুন হন স্ত্রী সাহিদা বেগম। পারিবারিক কলহের জের ধরে হত্যাকান্ডের এই ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

এ বিষয়ে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ফখরুল আলম বলেন, ‘একসময় দেশে যৌথ পরিবারের প্রচলন ছিল। পরিবার ও সমাজে প্রবীণদের শাসন ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু পরিবার ও সমাজ জীবনে এর পরিবর্তন ঘটেছে। এখন যৌথ পরিবার প্রথা কমে এসেছে। আমরা এক দ্রুত পরিবর্তনশীল সমাজে বাস করছি। অস্থির সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ভোগবাদ, সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয় আমাদেরকে স্বেচ্ছাচারি করে তুলছে। মানুষ আর একে অপরের কথা শুনতে চায় না, বুঝতেও চায় না। ফলে ভালোবাসার জায়গা দখলে নিচ্ছে অবিশ্বাস, ক্ষোভ ও স্বার্থ। সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে, পারিবারিক সম্পর্কের ভাঙন, সামাজিক একাকীত্ব, মানসিক অস্থিরতা, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, আইনের দুর্বল প্রয়োগ, সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ও মূল্যবোধের অবক্ষয়কে এসব ঘটনার জন্য দায়ি করে।’

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

সর্বশেষ ২৪ খবর