ঢাকা ৫ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৬:০৩ অপরাহ্ণ, মার্চ ২, ২০২১
নিজস্ব প্রতিবেদক
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের রোপওয়েতে রয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবান্বিত ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধে ৫নং সেক্টরের সাব সেক্টর হেডকোয়ার্টার ছিল এই ভোলাগঞ্জ রোপওয়েতে। শত্রুর বিরুদ্ধে সকল পরিকল্পনা এই ভোলাগঞ্জ সাব সেক্টর থেকেই নেওয়া হতো। কালের স্বাক্ষী এই রোপওয়েকে নিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে চিঠি চালাচালিতেই যেনো তার যৌবন ফুরিয়ে কঙ্কাল হয়ে যাচ্ছে।
দেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত রুজ্জুপথ ভোলাগঞ্জ রোপওয়েতে প্রকাশ্যেই চলছে পাথর লুটের মহোৎসব। সীমান্ত প্রহরী স্থানীয় বিজিবি ও রোপওয়ে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আরএনবি’র কতিপয় ঘুষখোর সদস্যকে ম্যানেজ করে স্থাপনা ভেঙে চলছে এই লুটপাটের উৎসব। ভারতের মেঘালয়া রাজ্যের পাহাড় প্রবাহিত ধলাই নদীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা দ্বীপরূপী রোপওয়ের বিভিন্ন স্থাপনার নিচে রয়েছে হাজার কোটি টাকার পাথর সম্পদ। এই সম্পদের ওপর লুলোপ দৃষ্টি পড়েছে একদল পাথরখেকোর। সেই পাথরখেকোরা দীর্ঘদিন ধরে রোপওয়ের বিভিন্ন স্থাপনার নিচে গর্ত করে পাথর উত্তোলন অব্যাহত রেখেছে। পাথর উত্তোলনের কাজটি প্রকাশ্যেই হচ্ছে যার কয়েকটি ভিডিও ক্লিপ স্থানীয় সংবাদ কর্মীদের হাতে রয়েছে।
সেই ভিডিও ক্লিপগুলোতে দেখা গেছে, রোপওয়ের মূল স্থাপনার নিচে কয়েকজন শ্রমিক শাবল দিয়ে গর্ত করে যাচ্ছে। কয়েকজন শ্রমিক মাথায় পাথর বোঝাই করে পাথর নিয়ে যাচ্ছে। পাশেই ধলাই নদীতে রাখা বারকি নৌকায় সেই পাথর বোঝাই করছে। প্রতিদিন শতাধিক বারকি নৌকা দিয়ে পাথর লুট করা হচ্ছে। প্রতি বারকি নৌকা করে পাথর নিতে বিজিবি ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য আরএনবিকে দিতে হয় ৫শ’ ও ১ হাজার টাকা করে। আর প্রতিটি বারকি নৌকায় বোঝাইকৃত পাথর বিক্রি করা হয় ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা করে। এভাবে শতাধিক বারকি নৌকা পাথর বিক্রি হচ্ছে প্রায় ৭ থেকে ৮ লক্ষ টাকায়। প্রতিদিন বিজিবি ও আরএনবিকে দিতে হচ্ছে প্রায় ৮০ হাজার থেকে ১লাখ টাকা ঘুষ।
পাথর লুট করার সময় একজন পাথর শ্রমিক সাংবাদিকদের বলেন, নৌকা প্রতি বিজিবিকে দিতে হয় ৫শ’ ও আরএনবি’কে দিতে হয় ১ হাজার টাকা করে। যেহেতু পাথর উত্তোলনের স্থানটি রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর দায়িত্বে সেই জন্যে তাদেরকে দিতে হয় ১ হাজার টাকা। আর রোপওয়ের পাশেই কালাইরাগ সীমান্তে বিজিবির টহল টিমের মুখ বন্ধ করতে তাদেরকেও দিতে হয় নৌকা প্রতি ৫শ’ টাকা করে ।
রাষ্ট্রের এই দুই সংস্থার মাঝখানে রয়েছে তৃতীয় একটি চাঁদাবাজ চক্র। তাদেরকে দিতে হয় নৌকা প্রতি ১ হাজার টাকা চাঁদা। স্থানীয় দয়ার বাজারের আশ-পাশে সেই চাঁদাবাজ চক্রের রয়েছে শক্তিশালী গ্রুপ। দিনের অধিকাংশ সময় সেই গ্রুপের সদস্যরা বিজিবি টহল ক্যাম্প ও আরএনবির সাথে সময় কাটায়। পর্যটকদের আনাগোনা কম হলেই সুযোগ বুঝে সেই ঘুষখোর নিরাপত্তা রক্ষী আরএনবি ও সীমান্ত প্রহরী বিজিবি সদস্যদের ম্যানেজ করে তারা চালায় পাথর লুটের তান্ডব।
রেলওয়ের রজ্জুপথ অফিস সূত্রে জানা গেছে, পাথর পরিবহনে স্থল কিংবা জলযানের বিকল্প হিসেবে ভোলাগঞ্জ থেকে সুনামগঞ্জের ছাতকে রজ্জুপথ স্থাপন হয় ১৯৬৪ সালে। এ রজ্জুপথে ১১৯টি খুঁটি রয়েছে। ভোলাগঞ্জ হচ্ছে রজ্জুপথের লোডিং স্টেশন (বাংকার) এবং ছাতক হচ্ছে খালাস স্টেশন। বাংকারের অধীন রয়েছে ৩৫৯ একর জমি। জমি, অবকাঠামোসহ রেলের স্থাপনা, যন্ত্রপাতি দেখভাল করতে ২০০০ সাল থেকে দায়িত্বে ছিল আনসার বাহিনী। কিন্তু তখন বেআইনিভাবে পাথর উত্তোলন ও বিক্রির ব্যাপক অভিযোগ ওঠে এই বাহিনীর বিরুদ্ধে। ফলে ২০১২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি আনসার বাহিনী প্রত্যাহার করে দায়িত্ব দেওয়া হয় আরএনবি’কে। একজন প্রধান পরিদর্শক ও দু’জন উপ-পরিদর্শকের নেতৃত্বে ৪৮ সদস্যের আরএনবি দল সার্বক্ষণিক ভোলাগঞ্জে রজ্জুপথের বাংকারে অবস্থান করে পাহারা দেওয়া কথা থাকলেও মাত্র ২০ জন আরএনবি সদস্য পাহারায় থাকেন। এর মধ্যেও চলছে বাংকার ভূমির পাথর লুটপাটের মহোৎসব।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রজ্জুপথ বাংকারের প্রবেশমুখের খুঁটিগুলো বেঁকে গেছে। ১২ থেকে ৯ নম্বর খুঁটি এবং বাংকারের পশ্চিম ও পূর্বদিকে প্রায় ১০/১১ একর জায়গায় যত্রতত্র খোঁড়াখুঁড়ি করে লুট করা হয়েছে পাথর। লোডিং স্টেশনের স্থানে কোনো গাছপালা নেই। প্রায় ১০ থেকে ১৫ ফুট গভীর গর্ত করে সেগুলো থেকে পাথর উত্তোলন করায় রেললাইনের আদলে রজ্জুপথে পাথর বাক্স পরিবহন পথের একাংশ উপড়ে পড়েছে।
পাথর ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের হিসাব অনুযায়ী, আরএনবির অধীনে থাকা অবস্থায় গত নয় বছরে রজ্জুপথের বাংকার থেকে অন্তত দুই হাজার কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে। পূর্বে আরএনবি তাঁদের মাসিক প্রতিবেদনগুলোতে এ পরিস্থিতিকে ‘রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের তৎপরতা’ উল্লেখ করলেও পাথর লুটপাটকারী কারও নাম-পরিচয় প্রকাশ করেনি।
লুটেরাদের কবলে পড়ে রোপওয়ের সোনালী যৌবন যেনো সময় থাকতেই ফুরিয়ে গেছে। রেলওয়ে প্রশাসনের উর্ধতন কর্তৃপক্ষের দায়সারা নিরাপত্তা ব্যবস্থা সরকারি এই রুজ্জুপথ ধ্বংসের একমাত্র কারণ। উর্ধতন কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনায় অনেকটা পাথরলুটের চিত্র ফুটে ওঠে। নিরাপত্তার দিতে আসা আরএনবি সদস্যরা মাত্র ১৫ দিনের জন্যে আসে। এই ১৫ দিনে যা পারে লুটে পুটে নেয় তারা। আবারো নতুন কোনো টিম আসে। তারাও সেই একই পাথর লুটের কাজে ব্যাস্ত থাকে।
এদিকে নিরাপত্তা রক্ষীদের না আছে আধুনিক সুযোগ সুবিধা, না আছে বর্ষায় নিরাপত্তা দেওয়ার কোনো নৌকা আর তারা দীর্ঘদিনের সেই সমস্যার দোহাই দিয়ে স্থানীয় পাথরখেকোদের সাথে হাত মিলিয়ে পাথর লুট রতে সহায়তা দিয়ে আসছে। নিরাপত্তা রক্ষীদের সাথে হাত মিলিয়ে পাথর খেকোরা ইতিমধ্যে রোপওয়ের প্রায় ৯০/৯৫ ভাগ সম্পত্তি ধ্বংস করে ফেলেছে।
এ নিয়ে ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট ও অনলাইন মিডিয়াতে বার বার সংবাদ প্রচার করার পরও কোনো কাজ হয়নি। উল্টো পাথর লুটেরাদের তান্ডব যেনো আরো বেড়েই চলছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় এই রোপওয়ে আমাদের আশ্রয় দিয়েছে, নিরাপত্তা দিয়েছে। কিন্তু আজ আমাদের চোখের সামনেই সব ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। রোপওয়ের নিরাপত্তা দিতে আসা নিরাপত্তা রক্ষীরাই যেন এর ভক্ষকরূপে আবির্ভুত হয়েছে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে রক্ষার আকুল আবেদন জানিয়েছেন।
সম্পাদক : জে.এ কাজল খান
স্বত্ত্ব: দৈনিক বিজয়ের কণ্ঠ (প্রিন্ট ভার্সন)
০১৭১৮৩২৩২৩৯
Design and developed by Yellow Host