ঢাকা ৬ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২১শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১০:৪৭ অপরাহ্ণ, মার্চ ৮, ২০২১
বিজয়ের কণ্ঠ ডেস্ক
সিলেটে দিন দিন নারী সহিংসতা ও হত্যার ঘটনা বেড়েই চলেছে। এর নেপথ্যে পারিবারিক কলহের জেরকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে করোনাকালীন সময়ে আর্থিক মন্দাবস্থা, কম রোজগার ও অভাব অনটন নিয়ে সংসারে কলহ বাড়ছে। পুরুষের এই ক্ষোভ-হতাশার শিকার হয়ে প্রাণ হারাচ্ছেন নারীরা।
অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন। কারও বেতন বা রোজগার কমে গেছে। এর প্রভাব পড়েছে তাদের মানসিক অবস্থায়। পুরুষের এই ক্ষোভ-হতাশার শিকার হচ্ছেন নারীরা। ফলে ঘরে নারীদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা আগের তুলনায় এখন অনেক বেড়েছে।
সিলেট জেলা ও মহানগর পুলিশের তথ্যে গত এক মাসে জেলায় এ ধরনের হত্যার শিকার হয়েছেন অন্তত ছয় নারী। সবগুলোই পারিবারিক কলহের জের ধরে ঘটেছে।
জানা যায়, ৮ মার্চ বিশ্বজুড়ে পালিত হবে নারী দিবস। এর ঠিক এক দিন আগে ৭ মার্চ সকালে সিলেটে নিজ ঘর থেকে সুফিয়া বেগম নামে ২২ বছরের এক নারীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় সুফিয়ার স্বামী সিলেট নগরের বাগবাড়ি এলাকার আয়নুল হককে আটক করেছে পুলিশ।
সুফিয়ার পরিবারের অভিযোগ, তাকে ইনজেকশনের মাধম্যে বিষজাতীয় কিছু প্রয়োগ করে হত্যা করেছেন আইনুল। এ ঘটনার তিন দিন আগে ৪ মার্চ সিলেটের দক্ষিণ সুরমার কুচাই থেকে ২৬ বছরের লাকি আক্তারের মরদেহ তার বাড়ি থেকে উদ্ধার করে পুলিশ লাকিকে হত্যার অভিযোগও উঠেছে তার স্বামী শহিদ আহমদের বিরুদ্ধে। পুলিশ ওই দিনই শহিদকে আটক করে। একদিন পর স্ত্রীকে হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেন শহিদ।
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি সিলেটের শাহপরান থানাধীন বিআইডিসি এলাকা থেকে এক গৃহবধূ ও তার দুই শিশুসন্তানের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় ওই নারীর সৎছেলেকে আটক করে পুলিশ। যার বয়স মাত্র ১৭।
পুলিশ জানায়, সৎমায়ের সঙ্গে মনোমালিন্যের জের ধরেই ওই কিশোর তাদের কুপিয়ে হত্যা করে। হত্যার পর ঘরে আগুনও ধরিয়ে দেয়। দেশে পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা অনেক পুরোনো। ঘরে নারীদের নির্যাতনের শিকার হওয়ার অভিযোগও অনেক দিনের। এখন তা একেবারে খুনোখুনির পর্যায়ে চলে গেছে। এখন ঘরে থেকেও প্রাণ বাঁচাতে পারছেন না নারীরা।
নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় ১৯১৪ সাল থেকে পালিত হয়ে আসছে নারী দিবস। ১৯৭৫ সাল থেকে জাতিসংঘ দিনটি পালন করছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে। এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ‘করোনাকালে নারী নেতৃত্ব, গড়বে নতুন সমতার বিশ্ব’।
তবে সিলেট মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি শিরিন আক্তার মনে করেন, করোনার কারণে উলটো বেড়েছে নারী নির্যাতন। তিনি বলেন, ‘করোনার প্রকোপ কিছু কমলেও মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা এখনও আগের অবস্থায় ফেরেনি। করোনায় অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন। কারও বেতন বা রোজগার কমে গেছে। এর প্রভাব পড়েছে তাদের মানসিক অবস্থায়। পুরুষের এই ক্ষোভ-হতাশার শিকার হচ্ছেন নারীরা। ফলে ঘরে নারীদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা আগের তুলনায় এখন অনেক বেড়েছে।’
সিলেট মহানগর পুলিশ কমিশনার নিশারুল আরিফের মতে, নারী নির্যাতনের বেশির ভাগ ঘটনাই আলোচিত হয় না। মামলা হয় না; মিডিয়াতেও আসে না। তিনি বলেন, ‘খুনোখুনির মতো বড় ঘটনা ঘটলে আমাদের কাছে আসে। ফলে ঘরের ভেতরে নারী নির্যাতনের বেশির ভাগ ঘটনাই আমরা জানতে পারি না। যতটুকু জানতে পারি, তার চেয়ে অনেক বেশি নির্যাতনের ঘটনা ঘটে।’
সিলেট উইমেন চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি স্বর্ণলতা রায় বলেন, ‘পুরুষ এখনও নারীকে তার অধীনস্থ ভাবে। ফলে সংসারে পুরুষের নির্দেশনা, ফুটফরমায়েশ খাটতে কোনো নারী আপত্তি জানালেই সে ক্ষেপে যায়। নির্যাতন চালায়। অনেক সংসারেই নারীর অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হওয়ার পথেও নিজের পরিবারই সবচেয়ে বড় বাধা হয়।’ স্বর্ণলতার মতে, পরিবারের পুরুষ সদস্যদের নারীকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা প্রদান করতে হবে। নারীকে সম্মান করতে হবে। ঘরের কাজ কেবল নারীর নয়, বরং নারী-পুরুষ উভয়েরই। এটা অনুধাবন করতে হবে। তাহলে পারিবারিক নির্যাতন অনেকাংশে কমে আসবে। গত এক মাসে সিলেটে পারিবারিক নির্যাতন ও ঘরের ভেতরে নারীকে হত্যার ঘটনায় কয়টি মামলা হয়েছে এ ব্যাপারে সিলেট জেলা পুলিশ ও সিলেট মহানগর পুলিশের কাছে রোববার জানতে চাইলেও দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা সুনির্দিষ্টভাবে কোনো তথ্য দিতে পারেননি।
তবে আইনজীবী শিরিন আক্তার বলেন, ‘ঘরের ভেতরে নারী নির্যাতনের ঘটনা আগের তুলনায় এখন অনেক বেড়েছে। প্রতিদিনই এ-সংক্রান্ত অভিযোগ নিয়ে আমাদের কাছে অনেকে আসেন। আগে নারীরা ঘরে থাকতেন। এখন অনেক নারীই কাজ করছেন। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। এটা কিছু পুরুষ মেনে নিতে পারছেন না। আবার আগে নারীরা সব ধরনের নির্যাতন মুখ বুঝে সহ্য করলেও এখন তারা অনেকে প্রতিবাদী হচ্ছেন। কিছু ক্ষেত্রে প্রতিবাদের কারণে তাদের ওপর নির্যাতন আরও বেড়ে যাচ্ছে।’
স্ত্রী লাকি আক্তারকে হত্যার দায় স্বীকার করে গত শনিবার আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে দক্ষিণ সুরমার কুচাইয়ের শহিদ আহমদ জানান, বিয়ের পর থেকেই স্ত্রীর সঙ্গে তার কলহ লেগে থাকত। এর জেরে বিভিন্ন সময় স্ত্রীকে নির্যাতন করতেন শহিদ। ৩ মার্চ রাতে ও পরদিন সকালে তাদের ঝগড়া বাঁধে। একপর্যায়ে লাকিকে বালিশচাপা দিয়ে হত্যা করেন শহিদ।
একইভাবে ২ মার্চ নিজ ঘরে খুন হন সিলেটের গোলাপগঞ্জের এক গৃহবধূ। তার নামও লাকি বেগম। স্ত্রীকে হত্যার অভিযোগে উপজেলার বাঘা ইউনিয়নের দক্ষিণ কান্দিগাও গ্রামের দানা মিয়াকে আটক করেছে পুলিশ।
গোলাপগঞ্জ থানা-পুলিশ জানিয়েছে, কলহের একপর্যায়ে দানা মিয়া ছুরি দিয়ে লাকি বেগমকে কোপাতে থাকেন। তার চিৎকার শুনে প্রতিবেশীরা গিয়ে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়ার পথেই তিনি মারা যান।
এর আগে গত ২৪ নভেম্বর সিলেট নগরের কাজীটুলা এলাকায় সৈয়দা তামান্না নামে এক নারীকে হত্যার ঘটনায় বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। প্রেমের বিয়ের মাত্র ছয় মাসের মাথায় স্বামী আল মামুন তাকে হত্যা করেন বলে অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় মামলা হলেও আল মামুন এখনও পলাতক।
এতগুলো ঘটনা ঘটলেও নারী নির্যাতন তেমন বাড়েনি বলে মনে করেন সিলেট মহানগর পুলিশ কমিশনার নিশারুল আরিফ।
তিনি বলেন, ‘ঘরের ভেতর নারীর প্রতি নির্যাতন সব সময়ই ছিল। এখন এটা বেড়েছে এমন দাবির সঙ্গে আমি একমত নই। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে। পুলিশের তৎপরতায় অভিযুক্তরা গ্রেপ্তারও হয়েছে।
সম্পাদক : জে.এ কাজল খান
স্বত্ত্ব: দৈনিক বিজয়ের কণ্ঠ (প্রিন্ট ভার্সন)
০১৭১৮৩২৩২৩৯
Design and developed by Yellow Host