ঢাকা ৬ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২১শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৭:৪২ অপরাহ্ণ, মার্চ ১৫, ২০২১
বিশেষ সংবাদদাতা, সুনামগঞ্জ
কালনী নদীর পারে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল। আবছায়া আলোতে কালনী পারের বাউল সম্রাট শাহ্ আব্দুল করিমের বাড়িতে ছুটে আসছিলেন মানুষ। বাউল করিমের গানের সুর ও প্রাণের টানে এই ছুটে আসা।
বাড়ির অদূরের উজানধল মাঠে তখন রাজ্যের ব্যস্ততা। মাঠের একপাশে মঞ্চে চলছে শেষ মুহুর্তের প্রস্তুতি। অন্যপাশে কেউ বা জায়গা চিহ্নিত করছেন, কেউ বা অস্থায়ী ঘর তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মাঠ জুড়ে জিনিসপত্রের স্তুপ।
উজানধলের মাঠে শিশু, কিশোর থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সী মানুষের ভিড়। খেলনা সামগ্রী কিনে বড়দের হাতে হাত ধরে হাসি মুখে বাড়ি ফিরছে শিশুরা। বছরজুড়ে অপেক্ষার পর এ ব্যস্ততা ভাটি অঞ্চলে তৈরি করেছে একটা ভিন্ন আমেজ। এ চিত্র গত (১৩ মার্চ) শনিবারের।
বাউল সম্রাট শাহ্ আবদুল করিমের জন্মভিটা সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার উজানধল মাঠের এ ব্যস্ততা মূলত দুই দিনব্যাপী ‘করিম লোক উৎসব’ উপলক্ষে। শাহ্ আবদুল করিমের ১০৫ তম জন্মবার্ষিকীতে লোক উৎসবের এই আয়োজন করে শাহ্ আব্দুল করিম পরিষদ।
শনিবার রাত ৭টার দিকে উজানধল মাঠে উৎসব শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ কালবৈশাখি ঝড়ের কারণে এই রাতে আর অনুষ্ঠান শুরু হয়নি। তবে বৃষ্টির জন্য প্রথম দিন মূল উৎসব না হলেও আড্ডা-গান থামেনি। দূর-দূরান্ত থেকে আসা ভক্ত-অনুরাগীরা গান পরিবেশন করেছেন করিমের বাড়িতেই।
বৃষ্টি আর বিদ্যুৎবিহীন ঘুটঘুটে অন্ধকার বাড়িতে চলছে করিমের গান। রাত সাড়ে ৭টার লোক শিল্পী আকাশ গায়েন তার দল নিয়ে শুরু করেন করিমের গান ‘আমি কি করিব রে প্রাণ নাথ তুমি বিনে/আমার সোনার অঙ্গ পুড়ে অঙ্গার হল দিনে-দিনে রে…’। ধারাবাহিকভাবে এই দল ‘শ্যামলও সুন্দরও রূপ আমি/যে দিন হতে হেরি গো…’,সহ বেশ কিছু গান পরিবেশন করেন। গভীর রাত পর্যন্ত সুরের মায়াজালে বাঁধা ছিলেন শ্রোতারা।
কথা হয় করিমপুত্র শাহ্ নূরজালালের সাথে। তিনি বলেন, ‘২০০৬ সাল থেকে আমার পিতা জীবিত থাকা অবস্থায় শুরু করেছিলাম শাহ্ আব্দুল করিম লোক উৎসব। লক্ষ্য ছিল শাহ্ আব্দুল করিমের সৃষ্টি প্রচার এবং প্রসারের জন্য। কোনো বছর সহযোগীতা পেয়ে থাকি। কোনো কোম্পানি স্পন্সর করে। কোনো বছর করে না। কষ্ট করে অনুষ্ঠানটি করতে হয়। এবছরও করোনাকালীন সময়ে কোনো সহযোগীতা না পেয়েও আমাদের নিজ উদ্যোগে ও শাহ্ আব্দুল করিম প্রেমীদের সহযোগীতা নিয়ে স্বাস্থ্য বিধি মেনে সংক্ষিপ্ত পরিসরে অনুষ্ঠান আয়োজন করেছি।’
দিরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদুর রহমান মামুন বলেন, ‘শাহ্ আব্দুল করিমের সৃষ্টিগুলো সাধারণ মনে হতে পারে। কিন্তু এটার আবেদনগুলো বৈশি^ক। তবে কথাগুলো ছিল সজল-সরল। বাউল সম্রাটের সাধনাগুলো যুগে যুগে অনেক মানুষের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে হচ্ছে আমাদের ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬৯’র এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১’র এর মুক্তিযুদ্ধে তার গান অনবধ্য ভূমিকা রেখেছে। সত্যি তিনি ক্ষণজন্মা পূরুষ। তার সৃষ্টিগুলো অমর। তার সঙ্গীত বিদ্যালয় ও কালচারাল সেন্টার করার জন্য আমাদের কাছে চিঠি এসেছে ভূমি মন্ত্রনালয় থেকে। ওই প্রেক্ষিতে আমরা কাজ করতেছি।’ বাউল করিমের অন্যতম শিষ্য আব্দুর রহমান বলেন, ‘মানুষকে সচেতন করার জন্য আব্দুল করিম গান লিখে গেছেন। তিনি প্রচার বিমুখ মানুষ ছিলেন। উনি বলতেন আমি নিভৃতে কাজ করে যাব। আমার এই সৃষ্টিটা একদিন মানুষের মধ্যে প্রচার হবে। আমি যদি ভালো কাজ করে যাই।’
তিনি আরো বলেন, ‘শাহ্ আব্দুল করিম যা করে গেছেন মনে প্রাণে করে গেছেন। যার দরুন মানুষ তাকে ভালোবাসে।’
করিমের বাড়িতে কথা হয় সুলতান আহমদের সাথে। তিনি বলেন, ‘বাউল শাহ আব্দুল করিম গানের মধ্যে মানুষের কথা বলে গেছেন। তার গানের কথায় খেটে খাওয়া মানুষের কথা ফুটে ওঠেছে। প্রথমবার এই উৎসব অংশ নিলাম। খুব ভালো লাগছে।’
পরদিন রোববার রাত ৮টায় সমবেত কণ্ঠে ‘স্বাধীন বাংলায় রে বীর বাঙালি ভাই/শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা চাই…’গান দিয়ে শুরু হয় করিম লোক উৎসব। মাঠ জুড়ে হাজারো ভক্ত-অনুরাগীর উপস্থিতিতে সোমবার ভোররাত পর্যন্ত চলে বাউল গান। শিল্পীর গানের সাথে নেচেগেয়ে মাতোয়ারা হন দূর-দূরান্ত থেকে আসা করিম-ভক্তরা।
প্রসঙ্গত, ২০০৬ সাল থেকে শুরু হয় লোক উৎসব। এই উজানধল গ্রামে ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম।
সম্পাদক : জে.এ কাজল খান
স্বত্ত্ব: দৈনিক বিজয়ের কণ্ঠ (প্রিন্ট ভার্সন)
০১৭১৮৩২৩২৩৯
Design and developed by Yellow Host