ঢাকা ৬ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২১শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১২:০৮ পূর্বাহ্ণ, মার্চ ২৫, ২০২১
নিজস্ব প্রতিবেদক
সিলেটে ফের করোনার ঝুঁকি বাড়ছে। চারদিকে বৃদ্ধি পেয়েছে সর্দি আর কাশি। হাসপাতালে গেলেই রিপোর্ট আসে পজিটিভ। এ কারণেই বন্ধ রয়েছে স্কুল কলেজ ভার্সিটি ও মাদরাসা। ভাষার মাসেও হয়নি বইমেলা। এছাড়াও সামনে পবিত্র রমজান মাস। ঝুকিপূর্ণ এ অবস্থায় সরকারি স্বাস্থ্যবিধির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শণ করে সিলেটে মেলা নামে করা হয়েছে গানবাজনা ও লটারী জুয়ার আয়োজন। প্রধানমন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে এ আয়োজন করেছেন এসএম মঈন খান বাবুল ওরফে মেলা বাবলু। আর এ নাম ভাঙিয়ে মেলার প্রতিবাদকারীদে বিরুদ্ধে দায়ের করা হচ্ছে মিথ্যে মামলাও। এতে সরকার ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে ক্রমশ ক্ষোভ বেড়েই চলছে স্থানীয় জনতার। এ ক্ষোভের বিস্ফোরণে ঘটে যেতে পারে বহু অঘটন।
সিলেট নগরের ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকা শাহজালাল উপশহর। এই এলাকার ই-বøক সংলগ্ন খেলার মাঠে মাসব্যাপী ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প পণ্যের মেলা-২০২১ আয়োজন করা হচ্ছে। আয়োজকদের দাবি- কিছু শর্ত দিয়ে মেলার অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন(বিসিক)। আর এই মেলার অনুমতি দিয়েছেন বাংলাদেশ সরকারের খোদ প্রধানমন্ত্রী। তাই এ মেলার বিরুদ্ধে কথা বলার বা মেলা বন্ধের দাবি জানানোর সাহস কারোর নেই।
মেলা সংশ্লিষ্ট এক পরিচালক সাংবাদিকদের জানান, এটা সাধারণ মেলা নয়, এটা খোদ প্রধানমন্ত্রীর (অনুমতি প্রাপ্ত) বিশেষ মেলা। এটার বিরোধীতা মানে প্রধানমন্ত্রীর বিরোধীতা। আর প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি বা আদেশের বিরোধীতা ও প্রতিবাদকারী যে কেউই হন না কেন, তার রেহাই নেই। এই মেলা আয়োজনের বিরুদ্ধাচরণ করতে গিয়ে চাঁদবাজির মামলা খেয়েছেন সিটি কাউন্সিলর অ্যাডভোকেট সালেহ আহমদ সেলিম। মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের পদও ইতোমধ্যে হারিয়েছেন তিনি। সুতরাং যারাই মেলার বিরোধীতা করবেন, তাদের জন্য প্রস্তুত রয়েছে মামলা ও গ্রেপ্তারী পরোয়ানা। তবে আয়োজকদের এহেন হুমকি-ধমকির কোন তোয়াক্কাই করছেন না স্থানীয় বাসিন্দারা। মেলা শুরুর আগেই এটা বন্ধ করতে মাঠে নেমেছেন তারা। করোনার প্রকোপ, শব্দদোষন, মসজিদে নামাজে বিঘœসৃষ্টি প্রভৃতি নানা কারণ ছাড়াই আরেকটি কারণ হচ্ছে মেলার পরিচালক সিলেটের বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত ‘মেলা ব্যবসায়ী’ এসএম মঈন খান বাবলু ওরফে মেলা বাবলু। যিনি এর আগেও সিলেট চেম্বার অব কমার্সের মেলাসহ বিভিন্ন মেলা পরিচালনা নিয়ে বিতর্কিত হয়ে ওঠেছেন।
বাবলু ২০১৭ সালের শোকের মাসে এই প্রতিষ্ঠান তৃণমূল নারী উদ্যোক্তা সোসাইটির (গ্রাসরুটস) উদ্যোগে শহরতলীর লাক্কাতুরায় মাসব্যাপী মেলা পরিচালনা করেন। মেলায় ‘দৈনিক প্রভাত সুরমা’ নাম দিয়ে র্যাফেল ড্র অনুষ্ঠান নামে চালিয়েছিলেন রমরমা জুয়া। এবারও প্রতিষ্ঠানের এই মেলায় র্যাফেল ড্র নামক দৈনিক জুয়া খেলা হবে বলে স্থানীয়দের ধারণা।
মেলার সাথে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, বিতর্কিত ‘মেলা ব্যবসায়ী’ এসএম মঈন খান বাবলু র্দীঘদিন থেকে সিলেটে কোনো মেলা করতে পারছেন না। স¤প্রতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তৃণমূল নারী উদ্যোক্তা সোসাইটির (গ্রাসরুটস)-এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন(বিসিক) থেকে অনুমোদন বাগিয়ে নেন এই মেলা বাবলু। মাসব্যাপী ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প পণ্যের মেলা-২০২১ নামে এ অনুমোদন পত্র অনুযায়ী গত ১২ মার্চ শুক্রবার থেকে মেলা শুরু এবং ১২ই এপ্রিল সোমবার শেষ করার কথা থাকলেও রমজান মাস ও ঈদকে টার্গেট করে মেলাটি নির্ধারিত তারিখে উদ্বোধন করছেন না এসএম মঈন খান ওরফে মেলা বাবলু।
মেলা বন্ধে আন্দোলনকারিদের দাবি, উপশহর মাঠের দু’প্রান্তে দুটি মসজিদ ও একটি স্কুল। এলাকার ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা মসজিদগুলোতে নামাজ আদায় করেন। এখানে মেলা হলে গানবাজনা হবে। রমজান মাসে মসজিদে মুসল্লিদের ইবাদত বন্দেগীতে চরম বিঘœ সৃষ্টি হবে। আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক মেলা হলে কোভিড-১৯ তথা করোনার ঝুঁকিও বেড়ে যাবার আশঙ্কা রয়েছে। স্কুল খুলে গেলে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের চলাচলে বিঘœসৃষ্টি হবে। শান্তিপূর্ণ বসবাসের স্বার্থে ওই মাঠে বাণিজ্যিক মেলা না বসানোর পক্ষে এলাকাবাসি এসব যুক্তি তুলে ধরেন। তাদের সাথে ঐক্যতা প্রকাশ করেছে সিলেটের ব্যবসায়ীরা। তারাও আন্দোলনে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
মেলার সাথে ঘনিষ্ট একটি সূত্র জানায়, করোনা মহামারিতে শাহজালাল উপশহরস্থ খেলার মাঠে মেলার আয়োজনের প্রতিবাদ এবং এলাকাবাসীকে নিয়ে মেলার কার্যক্রম বন্ধ করতে চেয়ে ছিলেন সিলেট সিটি করপোরেশনের ২২নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর অ্যাডভোকেট ছালেহ আহমদ সেলিম। তাই মেলার উদ্যোক্তা অনিতা দাস গুপ্তাকে দিয়ে কাউন্সিলর অ্যাডভোকেট ছালেহ আহমদ সেলিম-এর বিরুদ্ধে চাঁদা দাবির মামলা দায়ের করান মেলা বাবলু।
সূত্র জানায়, আনন্দঘন ঈদুল ফিতরকে টার্গেট করে পুরো রমজান মাস এই মেলা করার ইচ্ছা আয়োজকদের। তাই তারা সময়মত মেলা উদ্বোধন না করে রমজান মাসকে টার্গেট করে এসএমপির পুলিশ কমিশনার বরাবর একটি আবেদনও করেছে। তবে এসএমপির পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত আবেদনের কোনো জবাব পায়নি আয়োজকরা।
শাহজালাল উপশহরের ই-বøক সংলগ্ন খেলার মাঠে গিয়ে দেখা যায়, মাঠটির চারিদিক টিন দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে। ভেতরে তৈরি হচ্ছে দোকান কোঠা বা স্টল। স্টল নির্মাণে কর্মরত শ্রমিকদের কাজের তদারকি করছেন সেলিম নামের একজন লোক।
তিনি নিজেকে মেলার একজন পরিচালক পরিচয় দিয়ে সাংবাদিকদের জানান, এই মেলার অনুমোদন দিয়েছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মেলার প্রতি সিলেটের মন্ত্রী-এমপিসহ সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ নেতাদের পূর্ণ সম্মতি রয়েছে। নগর পুলিশও চায় এই মেলা হোক। তাইতো এই মেলার প্রতিবাদ করায় সিলেটের এক বড় নেতা স¤প্রতি পদ হারিয়েছেন। তিনি প্রতিবেদককে সংবাদ প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকার আহŸান জানান।
ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক এরাকায় এই মেলার আয়োজনে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ও সর্বনাশের কারণ হতে পারে সিলেটবাসীর জন্য। এমন আত্মঘাতি সিদ্ধান্তে সিলেটসহ সারাদেশের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা বড় চ্যালেঞ্জ হয়েও দাঁড়াতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. সুলতানা রাজিয়া জানিয়েছেন, করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব এখনও রয়েছে। এখনও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে রোগী আসছেন, হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন, মারাও যাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার সবার জন্য কাম্য। তাই অন্যদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মেলার আয়োজন না করাটাই উত্তম বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এ ব্যাপারে তৃণমূল নারী উদ্যোক্তা সোসাইটি গ্রাসরুটস’র জাতীয় সমন্বয়ক অনিতা দাস গুপ্তা বলেন, মেলার অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন(বিসিক)। বিসিক চেয়ারম্যানের সাথে আলাপ এবং সংবাদ সম্মেলন করে মেলাটি উদ্বোধন করা হবে। তিনি আরো বলেন, যেহেতু মেলার উদ্বোধনের তারিখ ও সময় চলে গেছে, সে ক্ষেত্রে রমজান মাসেই এই মেলা শুরু হবে।
তিনি আরো বলেন, এসএমপি পুলিশের অনুমতি আছে বলেই মেলাটি করতেই হবে। যেহেতু এই মেলাটি প্রাইম মিনিস্টার অফিসের অর্ডার। ‘মেলা ব্যবসায়ী’ এসএম মঈন খান বাবলু ইভেন্ট এই মেলাটি পরিচালনা করবে বলেও জানান তিনি।
উপশহরের স্থানীয় বাসিন্দারা এ ব্যাপারে সিসিক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, সিলেটের জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল ইসলাম, সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মো. নিশারুল আরিফসহ সংশ্লিষ্ট উর্ধতন মহলের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন।
মেলার অন্যান্য তথ্য সংগ্রহে বিজয়ের কণ্ঠ’র একটি অনুসন্ধানী টিম মাঠে রয়েছে। শীঘ্রই পরবর্তীতে বিজয়ের কণ্ঠে মেলায় জড়িতদের তালিকাসহ পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে।
সম্পাদক : জে.এ কাজল খান
স্বত্ত্ব: দৈনিক বিজয়ের কণ্ঠ (প্রিন্ট ভার্সন)
০১৭১৮৩২৩২৩৯
Design and developed by Yellow Host