ঢাকা ৫ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৭:৫০ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ২২, ২০২৫
সুয়েব রানা (জৈন্তাপুর)
রমজান মাসের এক বরকতময় সময়। সিলেট হরিপুর থেকে ক্বামরুল ইসলাম মাদ্রাসার সম্মানিত শিক্ষক হাফিজ মাওলানা হেলাল আহমদ এর নেতৃত্বে একটি তাবলিগ জামাত পাবনা সদর হেনায়েতপুর ইউনিয়ন ও সানিয়াদিয়া ও কৃষ্ণদিয়া গ্রামে ৪০ দিনের সফরকালে এক মসজিদে ৩ দিনের সফরে অবস্থান নেয়। তাঁরা দ্বীনের দাওয়াত, নামাজ, সুন্নতের শিক্ষা ও ইসলামী পরিবেশ তৈরিতে মনোনিবেশ করেন।
কিছুদিন অবস্থানের পর তাঁরা লক্ষ্য করেন, এলাকায় ইসলামী পরিবেশ, আমল, নামাজ ও দাওয়াতি চেতনা অনেকটাই দুর্বল। তখন জামাতের সাথীরা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন-এলাকার একজন যোগ্য, নম্র ও নামাজি কিশোরকে খুঁজে কওমি মাদ্রাসায় পাঠিয়ে দ্বীনের খেদমতে গড়ে তোলা হবে।
সেই সময় তাঁদের চোখে পড়ে রহমত উল্লাহ নামের এক কিশোর, যিনি নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতে পড়ে। জামাতের অন্যতম সদস্য হেলাল আহমদ ছেলেটির পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। যদিও পরিবার রাজি ছিল, কিন্তু এলাকাবাসীর কেউ কেউ ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয়ভীতি দেখাতে থাকে- ‘সিলেট দিলে আর ছেলেকে পাবেন না’ ইত্যাদি।
এই কথা শুনে মসজিদের একজন ইতেকাফরত দ্বীনদার ব্যক্তি, যিনি মসজিদের সভাপতিও ছিলেন, ছেলের পরিবারের সবাইকে সাহস দেন। তিনি বলেন, ‘ছেলের কোনো ক্ষতি হলে আমি দায়িত্ব নেব। আমি নিজে তাকে সিলেট নিয়ে গিয়ে ভর্তি করিয়ে আনব।’
তিনি নিজের হাতে রহমত উল্লাহকে নিয়ে সিলেটের ক্বামরুল ইসলাম মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়ে ফিরে আসেন। এরপর শুরু হয় রহমত উল্লাহর দীনি শিক্ষা-সফর।
প্রথমে প্রায় এক বছর হিফজসহ ৪ ক্লাস পড়েন ক্বামরুল ইসলাম মাদ্রাসায়। এরপর হরিপুর বাজার মাদ্রাসায় ১ বছর, জামিয়া মাহমুদিয়া যাত্রাবাড়ীতে ১ বছর, পরে যাত্রাবাড়ী শেখ সাহেবের মাদ্রাসায় দাওরায়ে হাদিসে ২ বছর ক্লাস করে সফলভাবে দাওরা সম্পন্ন করেন।
এরপর ভর্তি হন ঢাকার মারকাযুস শরিয়া আল ইসলামিয়া মাদ্রাসায়, যেখানে প্রায় ১ বছর ইফতা পড়াশোনা শেষে মুফতি হন।
এই দীনি সফলতার পিছনে মূল অবদান ছিল তাবলিগ জামাতের দাওয়াত, সাথীদের চেষ্টা, এবং কওমি মাদ্রাসার ধারাবাহিক শিক্ষাব্যবস্থা। এই ঘটনার আরেক অনন্য দিক—মসজিদ সভাপতি সাহেবের জীবন রূপান্তর।
এক সময় তিনিও সমাজে বিভিন্ন গুনাহ ও পাপাচারে লিপ্ত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি চরমোনাইর এক ইজতেমায় গিয়ে হেদায়েত পান এবং একেবারে দ্বীনের পথে ফিরে আসেন।
আজ তিনি নিজেই নয়, পুরো পরিবার ইসলামী শরীয়তের বিধান অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করেন।
দ্বীনি শিক্ষা শেষে রহমত উল্লাহ যখন নিজ এলাকায় ফিরে ইসলামি কাজ শুরু করেন, তখন মসজিদের সেই সভাপতি সাহেব নিজের আদরের দুলালি একমাত্র কন্যার জন্য রহমত উল্লাহকে পছন্দ করেন।
তিনি ও মেয়ের পরিবার এবং ছেলের পরিবার, সবাই একমত হয়ে সিলেটের ক্বামরুল ইসলাম মাদ্রাসার শিক্ষক হাফিজ মাওলানা হেলাল উদ্দীন সাহেবকে ফোন করে বিয়ের পরামর্শ নেন।
তিনি নিজে উপস্থিত থেকে সুন্নতী পদ্ধতিতে বিয়ের জন্য সব প্রস্তুতি নেন।
সিলেট থেকে তাবলিগ জামাতের তিনজন সাথী—হেলাল উদ্দীন, আব্দুল মুকিত ও সালমান- এ উপলক্ষে পাবনায় আসেন।
তাঁরা এলাকার মানুষকে দেখিয়ে দেন, কিভাবে একটি বিয়ে সম্পূর্ণ সুন্নতের আলোকে, সরলতা ও তাকওয়ার সঙ্গে আয়োজন করা যায়।
এটি ছিল পাবনার ইতিহাসে প্রথম সুন্নতী বিয়ে। কোনো গহনা, বাহারি সাজ, অনুষ্ঠান কিংবা গান-বাজনা ছাড়াই এই বিয়ে সম্পন্ন হয় কেবল ইসলামি শরীয়তের আলোকে।
এলাকাবাসী এমন বিয়ে আগে দেখেননি। হাজারো মানুষ ছুটে আসে দেখার জন্য। তারা বিস্ময়ে বলেন, এ তো আমাদের আকাবীরদের সুন্নতী বিয়ের জীবন্ত উদাহরণ।
পরিশেষে একটা কথা বলা চলে, রহমত উল্লাহর জীবনের প্রতিটি ধাপ—তাবলিগের মাধ্যমে হেদায়েত পাওয়া, কওমি মাদ্রাসায় অধ্যয়ন, মুফতি হওয়া এবং শেষে সুন্নতী বিয়ের মাধ্যমে সমাজে আদর্শ স্থাপন- সবকিছুই প্রমাণ করে যে, তাবলিগ ও কওমি মাদ্রাসা সমাজে সত্যিকারের পরিবর্তন আনতে পারে।
এই ঘটনা শুধু এক ব্যক্তির নয়, বরং একটি সমাজের পরিবর্তনের দৃষ্টান্ত। এটি যেন আল্লাহর পথে ফিরে আসা, হেদায়েত ও সুন্নতের বিজয়ের এক বাস্তব ছবি।
সম্পাদক : জে.এ কাজল খান
স্বত্ত্ব: দৈনিক বিজয়ের কণ্ঠ (প্রিন্ট ভার্সন)
০১৭১৮৩২৩২৩৯
Design and developed by Yellow Host