কিশোরকে বলাৎকারের পর হত্যা করে লাশ গুমের চেষ্টা

প্রকাশিত: ৯:৩৭ অপরাহ্ণ, আগস্ট ৬, ২০২৫

কিশোরকে বলাৎকারের পর হত্যা করে লাশ গুমের চেষ্টা

মামলা না নেওয়ায় লাশ নিয়ে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ * আড়াই ঘণ্টা বন্ধ ছিল যান চলাচল * ৫ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে যানজটের সৃষ্টি


ওমানীনগর প্রতিনিধি
সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলায় কিশোর নিখোঁজের এক সপ্তাহ পর তার মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) বিকালে কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল এলাকার রেলস্টেশন সংলগ্ন ডোবা থেকে মরদেহটি কুলাউড়া থানা পুলিশ উদ্ধার করে। এরপর মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে ময়নাতদন্তের পর বিকেলে তার পরিবারের নিকট মরদেহ হস্তান্তর করা হয়।
নিহত কিশোরের নাম রবিউল ইসলাম নাঈম(১৪)। সে উপজেলার গোয়ালাবাজার ইউনিয়নের গদিয়ারচর গ্রামের কনাই মিয়ার ছেলে।
এদিকে কুলাউড়া থানা পুলিশের পরামর্শে ওসমানীনগর থানায় মামলা করতে যান নাঈমের মা পারুল বেগম। কিশোর সন্তানের অর্ধ গলিত লাশ নিয়ে মামলা করতে সন্ধ্যা সাড়ে ৫ টার দিকে ওসমানীনগর থানায় উপস্থিত হন। এসময় পুলিশ মামলা অপারগতা প্রকাশ করে। তারা কুলাউড়া থানায় মামলা করার পরামর্শ দেন।
এদিকে মামলা গ্রহণ নিয়ে দুই থানার টানাটানিতে নিহতের পরিবার সিলেট-ঢাকা মহাসড়কে লাশ রেখে রাস্তায় শুয়ে পড়লে মুহুর্তেই যোগ দেন স্থানীয় লোকজন। হত্যাকারীদের ফাঁসি ও মামলা দায়েরের দাবিতে থানা ঘেরাও ও মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন স্থানীয়রা। এ সময় সিলেট-ঢাকা মহাসড়কে পৌণে ২ ঘণ্টা যান চলাচল বন্ধ থাকে। মহাসড়কের দুই দিকে প্রায় ৫ কিলোমিটার জুড়ে দুরপাল্লার যাত্রীবাহী বাসসহ শত-শত যানবাহন আটকা পড়লে চরম দুর্ভোগে পড়েন যাত্রী সাধারণ। পরবর্তীতে বিষয়টি আইনানুগভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাসে সেনাবাহিনী ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের হস্তক্ষেপে রাত ৮টা টার দিকে অবরোধ প্রত্যাহার করে দাফনের জন্য লাশ বাড়ি নিয়ে যায় স্বজনরা।
নিহতের পরিবার ও এলাকাবাসী সুত্রে জানা যায়, বিশ্বনাথ উপজেলর আটঘর গ্রামের কনাই মিয়ার ছেলে রবিউল ইসলাম নাঈমের বাড়ি হলে পরিবার নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করে ওসমানীনগর উপজেলার গোয়ালাবাজার ইউনিয়নের গদিয়ারচর গ্রামে। সে উপজেলার প্রধান বানিজ্যিক কেন্দ্র গোয়ালাবাজারের সিলেট-ঢাকা মহাসড়ক সংলগ্ন আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল হামিদের সুপ্রিম ফিলিং স্টেশনের মালিকানাধীন বগুড়া রেষ্টুরেন্টে নাইট শিফটে বয়ের কাজ করতো।
নাঈমের পরিবারের অভিযোগ, হোটেল মালিক বুলবুল আহমদ বিকৃত যৌন লিপ্সু একজন ব্যক্তি। এর আগে নারী এবং বলাৎকারের অভিযোগে বুলবুলকে স্থানীয় শালিস বৈঠকে অভিযুক্ত করে প্রকাশ্যে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। পুলিশ বরাবর কয়েকটি অভিযোগও রয়েছে বুলবুলের বিরুদ্ধে।
গত ২৫ জুলাই বৃহস্পতিবার নাঈম নাইট শিফট ডিউটি করে ভোরে বাসায় এসে তার মাকে শরীরের বিভিন্ন যায়গায় আঘাতের চিহ্ন দেখায় এবং ইশারায় তার মাকে বুঝায় যে, যৌন লিপ্সু হোটেল মালিক বুলবুল তার সাথে জোরপূর্বক বলাৎকারের কাজ করেছে। দরিদ্র নাঈমের মা মানসম্মান এবং অর্থনৈতিক অবস্থা চিন্তা করে বুলবুলের সাথে বিরোধে না জড়িয়ে এবং কাউকে কিছু না বলে একপর্যায়ে ছেলেকে হোটেল বয় এর কাজ থেকে ফিরিয়ে নেন।
নাঈমের মা জানান, গত ২৬ জুলাই নাঈম কাপড় ও পাওনা টাকা নেওয়ার জন্য রেষ্টুরেন্টে যায়। কিন্তু এরপর আর তার খোঁজ মিলেনি। রাত ১২ টায় নাঈমের বড় ভাই আব্দুল কাইয়ুম অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে হোটেলে গেলে বুলবুল বলেন নাঈম তো অনেক আগেই চলে গেছে। এরপর থেকেই নাঈম নিখোঁজ রয়েছে। নাঈমের আত্মীয় স্বজনরা বগুড়া হোটেলের ভাড়াটিয়া মালিক বুলবুলের কাছে বার বার নাঈমের খোঁজ নিতে গেলে একেক জনকে একেক তথ্য প্রদান করতে থাকেন। এতে নাঈমের পরিবার বুলবুলের প্রতি সন্দেহ বাড়তে থাকলে বিষয়টি অবগত করতে সুপ্রিম ফিলিং স্টেশনের মালিকানাধীন বগুড়া রেষ্টুরেন্টে মালিক আওয়ামী লীগ নেতা ও জেলা পরিষদের অপসারিত সদস্য আব্দুল হামিদকে বিষয়টি অবগত করলে তিনিও কালক্ষেপন করেন।
একপর্যায়ে তার মালিকানাধীন বগুড়া রেষ্টুরেন্টে ভাড়াটিয়া দোকান মালিক বুলবুলকে দিয়ে নাঈমের বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগে ওসমানীনগর থানায় একটি জিডি করতে সহায়তা করেন এবং ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে নানাভাবে চেষ্টা করে ব্যর্থ হন, বলে জানান নাঈমের স্বজনরা।
অপরদিকে ৩১ জুলাই নাঈমের মা পারুল বেগম ছেলের সন্ধান চেয়ে ওসমানীনগর থানায় একটি জিডি করতে যান। পুলিশ তার লিখিত জিডি না নিয়ে পাল্টা পুলিশের লিখিত একটি জিডিতে নাঈমকে মানসিকভাবে অসুস্থ দেখিয়ে পারুল বেগমরে সাক্ষর নেওয়া হয় বলে থানায় সাংবাদিকদের কাছে তিনি অভিযোগ করেন।জিডি-নং ১৫৬৫।
জিডি দায়েরের ৭২ ঘন্টা পর কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল এলাকার রেলস্টেশন সংলগ্ন ডোবায় অজ্ঞাতনামা এক কিশোরের মরদেহ কুলাউড়া থানা পুলিশ উদ্ধার করে মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে প্রেরণ করে। এরমধ্যে ফেসবুকে কুলাউড়ায় অজ্ঞাতনামা কিশোরের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে বলে স্থানীয় কিছু লোকজন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে প্রচার করলে পারুল বেগম সন্তানের ছবি দেখেই নিশ্চিত হন যে, এটাই তাদের আদরের সন্তান রবিউল ইসলাম নাঈমের মরদেহের ছবি।
কুলাউড়া থানা পুলিশ লাশের সুরতহাল সম্পন্ন করে ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালে প্রেরণ করেন এবং একটি ইউডি মামলা নেন। নিয়মিত মামলা রুজু জন্য নিহতের পরিবার ওসমানীনগর থানায় আসেন। এসময় তার স্বজনরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোনায়েম মিয়াকে মামলা গ্রহণ করতে অনুরোধ করেন। কিন্তু ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তাতেও রাজি না হয়ে কুলাউড়া থানায় মামলা করার পরামর্শ দেন। মামলা গ্রহণে দুই থানার ধাক্কাধাক্কিতে ক্ষোভে ফেটে পড়েন স্বজন ও এলাকাবাসী। মামলা দায়েরের দাবিসহ বিকৃত যৌন লিপ্সু বুলবুলের ফাঁসি ও তার মদতদাতা পতিত আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল হামিদকে যোগসুত্রতা খতিয়ে দেখার দাবিতে প্রায় পৌণে ২ ঘন্টা ওসমানীনগর থানা ঘেরাও ও সিলেট ঢাকা মহাসড়ক অবরোধ করে স্থানীয় লোকজন। অবশেষে সেনাবাহিনী ও পুলিশের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে কুলাউড়া থানায় মামলা নেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হলে অবরোধ প্রত্যাহার করে নেয় জনতা। তবে লাশ উদ্ধারের আগের দিন নিহতের মায়ের জিডির ভিত্তিতে পুলিশ রেস্তোরাঁ মালিক বুলবুলকে আটক করেছে বলে জানা যায়।
এদিকে রবিউলের পরিবারের দাবি রেষ্টুরেন্ট মালিক বুলবুল মিয়া হত্যা করে রবিউলের লাশ কুলাউড়ায় ফেলে আসে। নিহত রবিউলের মামা রাহেল আহমদ বলেন, আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল হামিদ বিষয়টি ধামাচাপা দিতে তিনি সময় পার করেছেন। নাঈমকে বুলবুল সহ অন্যান্য কর্মচারীরা সংঘবদ্ধভাবে খুন করে লাশ গুম করার চেষ্টা করেছে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল হামিদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তার ব্যক্তিগত মুঠোফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।
কুলাউড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উমর ফারুক জানান, ঘটনার শুরুটা যেহেতেু ওসমানীনগরের তাই ওসমানীনগর থানায় মামলা করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
সিলেটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ওসমানীনগর সার্কেল) আশরাফুজ্জামান আশিক বলেন, মামলা না নেওয়ার অভিযোগ সঠিক নয়, নিহত ব্যক্তির মরদেহটি কুলাউড়া থানায় উদ্ধার হওয়ার ফলে সেখানে মামলা করার পরামর্শ দেওয়া হয়।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

সর্বশেষ ২৪ খবর