ঢাকা ৫ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৯:০৯ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ৪, ২০২৫
নিজাম উদ্দিন, কোম্পানীগঞ্জ
শিক্ষাক্ষেত্রে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন অবিশ্বাস্য অগ্রগতি হয়েছে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার। অবহেলিত এই জনপদের বর্তমান শিক্ষার হার ৬১.৩৩%। যা শুধু অবিশ্বাস্যই নয়, বরং আগামীতে আরো ভালো হবে এমন আশা জাগানিয়াও বটে। ১৯৮৪ সালে উপজেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া এই কোম্পানীগঞ্জে মাত্র ২৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ হয়েছিল, কালের পরিবর্তে এখন বিপুল পরিমাণ প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও মাদরাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। নিরক্ষরতার গ্লানি মুছে স্বাক্ষরতায় নিজেদের আগ্রহ জানান দিচ্ছেন উপজেলাবাসী।
উপজেলার সচেতন নাগরিকবৃন্দ জানান, স্বাধীনতার পর থেকে কোম্পানীগঞ্জের শিক্ষা ব্যবস্থা খুবই নাজুক ছিল। ১৯৭৩ সালে সারাদেশে যখন প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ হয় তখনও বৈষম্যের শিকার হয়েছিল কোম্পানীগঞ্জ। উপজেলা হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে এর শিক্ষা ব্যবস্থা সম্প্রসারিত হতে থাকে। বাড়তে থাকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। উপজেলা সদর ছাড়াও প্রতিটি গ্রামে-গঞ্জে গড়ে উঠা এসব প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জনপদে শিক্ষার আলো ছড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে থাকে। ফলে নিরক্ষরতা দূর হয়ে উপজেলা জুড়ে স্বাক্ষরতার হার বাড়তে থাকে। সর্বশেষ ২০২৫ সাল পর্যন্ত এই উপজেলার শিক্ষার হার দাঁড়ায় ৬১.৩৩% শতাংশে। বেকারত্ব দূরীকরণে শিক্ষার এই আলোকিত প্রভাবে গোটা উপজেলাই শুধু আলোকিতই হয়নি, সেইসাথে দেশ-বিদেশে অবস্থানরত উপজেলার সুনামগাঁথা নাগরিকদের দ্বারা দেশের অর্থনৈতিক খাতেও বেশ জোগান দিচ্ছে বলে তারা মনে করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কোম্পানীগঞ্জ একটি পিছিয়ে পড়া অবহেলিত জনপদ। যার বর্তমান শিক্ষার হার ৬১.৩৩%। যা দেশ স্বাধীনের পর গোয়াইনঘাট ও ছাতক থানার অংশ ছিল। জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৭৬ সালে প্রথমে থানা ও ১৯৮৪ সালে উপজেলা প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৩ সালে সারাদেশে যখন প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ হয় তখন কোম্পানীগঞ্জে ২৮টি বিদ্যালয় জাতীয়করণ হয়। পরবর্তীকালে ১৯৮৬ সালে আরো ৪ টি বিদ্যালয় জাতীয়করণ হয় এবং রেজিস্ট্রার বেসরকারী ও কমিউনিটি মিলে আরো প্রায় ২৫/৩০ টি বিদ্যালয় ছিল। ৯০ এর দশকে উত্তরবঙ্গ, সুনামগঞ্জ, ময়মনসিংহ থেকে কিছু শিক্ষক কোম্পানীগঞ্জে এসে শিক্ষকতা পেশায় জড়িয়ে বেশ কিছু বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনে এলাকাবাসীকে সহযোগীতা করেন। এসব বহিরাগত শিক্ষকদের কাছে কোম্পানীগঞ্জ বাসী কৃতজ্ঞ।
২০০০ সালের দিকে ৩২ টি সরকারি ও ৩৬টি রেজিষ্টার বেসরকারী ও একটি কমিউনিট বিদ্যালয় নিয়ে চলছিল কোম্পানীগঞ্জে প্রাথমিক শিক্ষা। ২০১৩ সালে দুই ধাপে ৩৬ টি রেজিস্টার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করন হলে আমাদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা দাড়ায় ৬৮ টিতে।এরই মধ্যে সরকার ১৫০০ বিদ্যালয় প্রকল্প হাতে নিলে আমরা আরো ৫ টি সরকারি বিদ্যালয় পেয়ে যাই।এখন মোট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৭৩ টি বেসরকারী ৫ টি কমিউনিটি ১ টি ও ২১ টি কেজি স্কুল আছে। এসব স্কুলে প্রায় ২৪০০০ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে।
এদিকে সরকারি স্কুলে প্রধান ও সহকারী ৪৬৪ পদের মধ্যে মোট ৩৯৩ জন কর্মরত, বেসরকারী ও কমিউনিটিতে প্রায় ৩০ জন এবং কেজি স্কুলগুলোতে প্রায় ২০০ জন শিক্ষক কর্মরত আছেন। এছাড়া গত ৩/৪ বছরে ৫/৬ জন শিক্ষক অন্য চাকুরিতে চলেগেছেন।
শিক্ষার মানের কথা বলতেগেলে শিক্ষানীতি ও গত সরকারের তালগোল পাকানো শিক্ষা ব্যবস্থা ও দুই বছরের করোনা পরিস্থিতিকে সামনে আনলে তেমন একটা ভালো মান বলা যাবেনা। আর সাথেতো শিক্ষা অফিসের জনবল স্বল্পতা ও শিক্ষক স্বল্পতাতো আছেই। উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসারের পদ ৪ টি থাকলেও কষ্মিন কালেও ৪ টি পদ পূর্ণ হয়নি। ২০১২-১৩ সালের পর থেকে একজন সহকারী শিক্ষা অফিসারেই চলছে অফিস। আর শিক্ষক স্বল্পতার কথা যদি বলি তাহলে বলতে হয় ৪ জন শিক্ষকের স্কুলে মাত্র একজনে ক্লাস কার্যক্রম ও অফিস কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন এবং করছেন এরকম স্কুল আছে ৩/৪ টি।তবে এখানে একটি নীতিমালার সমস্যা থাকায় শহর ঘেষা এবং রাস্তার পাশের স্কুলগুলোতে পর্যাপ্ত শিক্ষক আছেন।এই নীতিমালার কারনে উপজেলা থেকে কোন শিক্ষককে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বদলী বা ডেপুটেশন দেওয়া যায়না।সব মিলিয়ে কোনমতে চলছে কোম্পানীগঞ্জের প্রাথমিক শিক্ষা। একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয় কয়েকজন শিক্ষকের সাথে আলাপ কালে জানা যায় করোনার পর থেকে স্কুলগুলোতে ছাত্র সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে তবে তারা ঝরে পড়েনি তারা মাদ্রাসা শিক্ষায় ঝুঁকে পড়েছে এবং এই হার দিন দিন বাড়ছে।উপজেলা শিক্ষা অফিসার টিটু কুমার দে বলেন আমাদের অফিসের লোকবল কম নিয়ে এবং শিক্ষক স্বল্পতা নিয়েই আমরা উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। শিক্ষার মান যাতে বৃদ্ধি হয় সেজন্য আমি এবং আমার সহকারী শিক্ষা অফিসার ঘন ঘন স্কুল পরিদর্শনসহ বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা :
স্বাধীনতার অনেক আগে ১৯৫৭ সালে ভাটরাই উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এই একটি মাত্র মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে কোম্পানীগঞ্জের মাধ্যমিক শিক্ষা চলে দেশ স্বাধীনের পর ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত। ১৯৮৬ সালে পাড়ুয়া আনোয়ারা উচ্চ বিদ্যালয় ও হুমায়ুন রশিদ উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে উচ্চ বিদ্যালয়ের সংখ্যা দাড়ায় মাত্র ৩ টি। তার পর ১৯৯০ সালের পর একে একে শহীদ স্মৃতি টুকেরবাজার, থানাসদর, ঢালার পার, ছনবাড়ী, কলাবাড়ী, পূর্নাছগ্রাম, বর্নি, পুটানারা উচ্চ বিদ্যালয় সহ এই মুহুর্তে ১৭ টি উচ্চ বিদ্যালয় ও ৩ টি কলেজিয়েট, ১টি কারীগরি কলেজ ও একটি ডিগ্রী কলেজ আছে আমাদের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষায়। উল্লেখ্য যে ১৯৯৭ সালে আমাদের প্রথম কলেজিয়েট স্কুল পাড়ুয়া আনোয়ার স্কুল এন্ড কলেজ এবং ২০১২ সালে প্রথম পুর্নাঙ্গ কলেজ এম সাইফুর রহমান ডিগ্রি কলেজ এবং উপজেলার একমাত্র সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থানা সদর মডেল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় যা ২০১৮ সালে জাতীয়করণের মাধ্যমে সরকারি হয়। মাধ্যমিক ও কলেজে মোট এমপিওভুক্ত শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় ২০০ জন এবং শিক্ষার্থী সংখ্যা স্কুলে ১৪, ৯৮২জন, কলেজে ১৩৫১ জন। মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার জনাব বদিউজ্জামাল বলেন আমি ১৯৯৫ সালে এই উপজেলায় যোগদানের সময় এমপিও ভুক্ত মাত্র ৩ টি প্রতিষ্ঠান পাই।তারপর বিভিন্ন এলাকায় স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলসভাবে কাজ করেছি তবে আশানুরূপ ফল পাইনি।এখন আমার আশা আরো কয়েকটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা বিশেষ করে দুয়েকটি কারিগরি স্কুল যেখানে শিক্ষার্থীরা হাতে কলমে কাজ শিখবে।
এখানে একমাত্র ডিগ্রি কলেজের সার্বিক পরিসংখ্যান টা তুলে ধরা উচিত বলে মনে করি। এম.সাইফুর রহমান ডিগ্রি কলেজ ২০০২ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী এম সাইফুর রহমান প্রতিষ্ঠা করেন এবং তাঁর নামানুসারে কলেজটির নামকরন হয় এম. সাইফুর রহমান কলেজ। ১১.৬৭ একর ভুমির উপর একটি একাডেমিক ভবনে ৯০ জন শিক্ষার্থী ও ৭/৮ জন শিক্ষক নিয়ে কলেজটি যাত্রা শুরু করলে এলাকাবাসীর কাছে আশার আলো ফোটে। শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথ স্বপ্ন জাগে ডিগ্রিতে রূপান্তরিত করার এবং সেই স্বপ্ন ২০১২ সালে কর্তৃপক্ষের কাছ ধরা দেয়।২০১২ সালে কলেজটি ডিগ্রি কলেজ হিসেবে অনুমোদন পায়।এই মুহুর্তে কলেজটির ৩ টি ভবন এইচ এস সি তে ৩০০ জন, ডিগ্রিতে ১৫০ জন শিক্ষার্থী এবং ১৫ জন এমপিও, ৫ জন নন এমপিও শিক্ষক ও ৫ জন কর্মচারী নিয়ে কার্যক্রম চলছে।ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোঃ মুরশেদ আলম বলেন ২০০২ সালে বিএনপি সরকারের আমলে এম. সাইফুর রহমানের নামে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় গত আওয়ামী সরকারের বিমাতসুলভ আচরেন স্বীকার হয় প্রতিষ্ঠানটি। এর পাশাপাশি ফ্যাসিবাদের দোসর সাবেক অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম গত ২৩ বছর কলেজটিকে ধ্বংস করে ফেলেছে এবং তার অপকর্মের জন্য ৫ আগষ্টের পর ছাত্র জনতার রোষানলে পড়ে পদত্যাগ করে পালিয়েছে।এখন আমি দায়িত্ব পেয়েছি নতুন কমিটি গঠন হয়েছে আমাদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রাণ চাঞ্চল্য ফিরে এসেছে। অচিরেই কলেজটি উপজেলাতে শিক্ষার ধূতি ছড়াবে বলে আশাবাদী।
কলেজের নবনির্বাচিত সভাপতি কেন্দ্রীয় বিএনপির সহ সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব মিফতা সিদ্দিকি বলেন আমি সহ একঝাঁক তরুন এলাকবাসী নিয়ে একটি পরিচালনা কমিটি পেয়েছি আমরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে উপজেলাবাসীকে কলেজটির শিক্ষা ও অবকাঠামোগত উন্ময়ন প্রত্যক্ষ করাতে পারব ইনশাআল্লাহ। গত ফ্যাসিস্ট সরকার শুধু এম সাইফুর রহমানের নাম থাকায় কলেজটিতে কোন উন্নয়ন বা জাতীয়করণ করেনি।আগামীতে বিএনপি ক্ষমতায় আসলে জাতীয়করণকৃত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকায় প্রথম দিকে এম সাইফুর রহমান কলেজের নাম থাকবে ইনশাআল্লাহ।
এই হলো আমাদের মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থার পরিস্থিতি।
এবার আসি মাদ্রাসা শিক্ষায়-কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় মাদ্রাসা শিক্ষায় ১ টি আলিম, ৩টি দাখিল ১১ টি এবতেদায়ী ও ৬০ টি কওমি মাদ্রাসা, প্রায় ৩৫০ জন শিক্ষক এবং আলিম, দাখিল, এবতেদায়ীতে ১৬৪৫ জন, কওমি মাদ্রাসায় ১৬৯৬৭ জন শিক্ষার্থী নিয়ে চলছে। মাদ্রাসা শিক্ষা আমাদের বুনিয়াদি শিক্ষার অংশ।এই খাতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা তেমন একটা না থাকায় মানবসম্পদ উন্নয়ন তেমন একটা হচ্ছে না।
এই পরিস্থিতিতে আমরা কিভাবে শিক্ষা ক্ষেত্রে এগিয়ে যেতে পারি তাই নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার মান বাড়াতে হলে এখনই উপজেলার সুশীল সমাজের দায়িত্বশীলদের এগিয়ে আসতে হবে।বিশেষ করে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে এসব সমস্যা মোকাবেলা করে যদি আমরা এগিয়ে যেতে পারি তাহলে শিক্ষা ক্ষেত্রে এই এলাকায় বিপ্লব ঘটতে পারে।
সর্বোপরি কোম্পানীগঞ্জের শিক্ষা ব্যবস্থা সিলেট জেলার অন্যান্য উপজেলা থেকে অনেকটা পিছিয়ে আছে।আমরা কোম্পানীগঞ্জের সচেতন নাগরিকসমাজ যদি এখনই আমাদের শিক্ষা ব্যস্থার উন্নয়নে কাজ না করি তাহলে আমরা এগিয়ে যেতে পারব না।
সম্পাদক : জে.এ কাজল খান
স্বত্ত্ব: দৈনিক বিজয়ের কণ্ঠ (প্রিন্ট ভার্সন)
০১৭১৮৩২৩২৩৯
Design and developed by Yellow Host