ঢাকা ১৪ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৭:৩০ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ১১, ২০২৫
মো. মঈন উদ্দিন মিলন, বিশেষ প্রতিনিধি
সিলেটের সীমান্ত জনপদ কোম্পানীগঞ্জের বেশ কটি সীমান্ত পথে বিভিন্ন কায়দায় ভারত থেকে ফেনসিডিল, ইয়াবা, হুইস্কি ও বিভিন্ন ব্রান্ডের মদসহ সমাজ বিধ্বংসী মাদকদ্রব্য অনায়াসে নামাচ্ছে কয়েকটি চক্র। নিজস্ব লোকদের দিয়ে নিরাপদে সেগুলো দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচারও করছে চক্রটি। সেইসাথে ঢাকাগামী মাদক ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি উপজেলার বর্নী, গৌরিনগর, খাগাইল, টুকের বাজার, বউবাজার, পাড়ুয়া মহাসড়ক এলাকায়ও বিক্রি করা হয় এসব মাদক। এমনটি নিশ্চিত করেছেন স্থানীয় বিভিন্ন বিশ্বস্থ সূত্র।
সেই সূত্রের তথ্য মতে মাদক কারবারে জড়তি এমন শতাধিক কারবারির নাম সংগ্রহ করেছে দৈনিক বিজয়ের কণ্ঠ। যাদের বিরুদ্ধে ইতোপূর্বে মামলা, জেল জরিমানা হয়েছে মর্মে উপজেলা প্রশাসন কোম্পানীগঞ্জ ও থানা সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে। সম্প্রতি থানা পুলিশের অভিযানে গত একমাসে বিপুল পরিমাণ মাদকের চালান ধরা পড়েছে। তবুও থামানো যাচ্ছে না মাদকের ভয়াল শেকড়। এ নিয়ে উপজেলাজুড়ে অশনি সংকেত রয়েছে বলে ধারনা করছেন স্থানীয় সচেতন মহল। যেটি রীতিমত উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ।
সূত্র জানায়, সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে সিলেট শহর থেকে শতশত মাদকসেবি মহাসড়ক এলাকায় বিচরণ শুরু করে। অনায়াসে তাদের হাতে তুলে দেয়া হয় চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্নরকম মাদক। বিনিময়ে হাতিয়ে নেওয়া হয় বড় অঙ্কের অবৈধ অর্থ।
এদিকে, উপজেলায় মাদক ও চোরাচালন প্রতিরোধে সচেতন নাগরিক সমাজ ও তৌহিদী জনতা বার বার সভা সমাবেশ করেও ব্যর্থ হচ্ছেন। ব্যর্থতার কারণ হিসেবে তারা স্থানীয়ভাবে যুব সমাজকে ওই বেপরোয়া পথে যুক্ত হওয়ার বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখছেন। তারা বলছেন, এলাকায় মাদক কারবারিদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অধিক মুনাফা লাভের আশায় প্রতিনিয়ত কোনো না কোনো যুবক ওই পথে নাম লেখাচ্ছে। ফলে দীর্ঘ হচ্ছে অপরাধীদের তালিকা। যা দ্রুত সম্ভব নির্মূল করা না গেলে, আগামী প্রজন্ম ক্রমেই ধ্বংস হবে মাদক করাল গ্রাসে।
অনুসন্ধানকালে খাগাইল/ গৌরিনগর এলাকার একজন সচেতন নাগরিক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বলেন, এলাকার বেশিরভাগ যুবক এই মাদক সেবনসহ মাদকদ্রব্য কেনা বেচায় জড়িয়ে পড়েছে। অভিভাবকদের সচেতনতার অভাবে আজ ধংসের পথে যুবসমাজ।
তিনি আরো বলেন, কে কার কথা শুনে? অনেক মুরব্বি যারা সমাজ/ পঞ্চায়েতের মুরব্বি তাদেরই ভাই ভাতিজা ছেলে কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে পড়েছে মাদকব্যবসায়। ফলে সামাজিক বিচারে মাদক নির্মূলের আন্দোলন ব্যহত হচ্ছে।
এদিকে বৃহত্তর পাড়ুয়ায় যুব সমাজের উদ্যোগে মাদক কারবারিদের ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে। সামাজিক আন্দোলনে মাদকের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত হচ্ছে সভা সমাবেশ। উপজেলার চাটিবহর /খাগাইল এলাকায় মাদকের বিরুদ্ধে এলাকাবাসী প্রতিবাদ সভা ও মানববন্ধন করেছেন।
সম্প্রতি কোম্পানীগঞ্জে থানার অভিযানে মাদকসহ বেশ ক’জনের নাম ঠিকানা প্রতিবেদককে জানিয়েছেন ওসি রতন শেখ পিপিএম। তারা হলেন- জগন্নাথপুরের হানিফ মিয়া, পাড়ুয়ার ফকির আলী, কাওছার, রহমত, কালা মিয়া,দয়ার বাজারের জুয়েল, ফরিদ, উৎমা এলাকার সুজন,সালা উদ্দিন, টুকের বাজারের অভিযানে রাহেলা,মাসুদ, আশরাফুল, পুটামারার সোহেল সহ অনেককে মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা সহ মাদকের সম্পৃক্ততার অভিযোগে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে, দৈনিক বিজয়ের কণ্ঠ টিম মাদকের ভয়াল রাজ্য কোম্পানীগঞ্জ সীমান্তসহ মহাসড়কে মাদক বিক্রির খোলা হাট গোপন পরিদর্শনসহ অর্ধ শতাধিক মাদককারবারির নাম তালিকাভুক্ত করেছে। যাদের বিরুদ্ধে অনেকের বিরুদ্ধে মামলা, জেল খেটে ফের ব্যবসায়, আবার নীরবে অনেকে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে করছেন রমরমা মাদকব্যবসা।
বিজয়ের কণ্ঠ টিমের অনুসন্ধানে একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রের তথ্যমতে মাদক কারবারে সক্রিয় রয়েছেন বর্নী গৌরিনগর গ্রামের (নামের প্রথমাক্ষর) ঈ, নু, ক, জ, ক, ল, ত, শ, আ, স, ক, ম, দ-সহ অন্তত ২০ জন।
খাগাইল এলাকার জ, ত, ব, জ, ব, সহ অন্তত ১০ জন এবং বউবাজার /টুকের বাজার এলাকার আ, ব, র প্রথমাক্ষর সম্বলিত ব্যক্তিসহ ১০ জন।
এছাড়াও পাড়ুয়া এলাকার ক, দ, আ, র, স, ম সহ ১৩ কারবারি। ভোলাগঞ্জ আদর্শ গ্রামের আ, হ, স, হ সহ ৭ জন। উৎমা এলাকার লামাগ্রামের ন, ম, ক, আ, এ, ক, স, শ সহ ওই গ্রামেরই বাসিন্দা অন্তত ১২ জন। বরমসিদ্ধিপুর গ্রামের ত, ই, ফ, ক, র, আ, ম, ই, শ, দ, জ, হ, জ সহ ১৫ জন। দয়ার বাজার/ কালাইরাগ গ্রামের হ, ফ, র, জ সহ মোট ৫ জন। ছনবাড়ী এলাকার আ, ত, ই, দ, র-সহ ৭ জন প্রথমাক্ষর সম্বলিত নামের ব্যক্তিগণ।
বিশিষ্টজনের মতামত :
এ বিষয়ে স্থানীয় অধিবাসী, বাংলাদেশ ইমাম মুয়াজ্জিন সিলেট জেলা শাখার সভাপতি মাওলানা এহসান উদ্দিন বলেন, “বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসন আইন শৃঙ্খলা কমিটির সভায় প্রায়সময় তুলে ধরেছি। সিলেট ভোলাগঞ্জ মহাসড়কে প্রায়ই দেখা যায় মাদকসেবী/ কারবারিদের আনাগোনা। এ থেকে বেরিয়ে আসতে কোম্পানীগঞ্জে মাদক স্পট এলাকা চিহ্নিত করে ‘সামাজিক মূল্যবোধ ও শৃঙ্খলা বজায়’ কমিটি গঠনের পরামর্শ দেন। এক্ষেত্রে প্রশাসনের মাধ্যমে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সচেতন নাগরিক, মসজিদের ইমাম যুবসমাজের প্রতিনিধি সমন্বয়ে গঠিত কমিটি মাসিক রিপোর্ট পেশ করার ব্যবস্থা করলে সে অনুযায়ী অনেকটা দমন হবে বলে জানান তিনি।”
এ বিষয়ে স্থানীয় এম. সাইফুর রহমান ডিগ্রি কলেজ ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোরশেদ আলম বলেন, ‘সীমান্ত কোম্পানীগঞ্জ আজ মাদকের ছড়াছড়িতে অশান্ত নেতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। ভারত মাদকের বিষয় প্রমোদ করলেও আমরা তা করতে পারি না। তিনি সম্প্রতি ব্যাপকহারে কোম্পানীগঞ্জ থানা কর্তৃক মাদকের চালান আটকের ভূয়সী প্রশংসা করে সামাজিক, রাজনৈতিক, আলেম ওলামা, যুবসমাজের সমন্বয়ে গঠিত মাদক বিরোধী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে প্রশাসনের সহায়তায় এগিয়ে আসা জরুরি বলে মনে করছেন।’
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আরো বলেন, উঠতি বয়সী তরুণরা আজ ইয়াবাসহ মাদকাসক্ত হচ্ছে এতে শিক্ষার হার কমতে যাচ্ছে যা কোম্পানীগঞ্জ বাসীর জন্য অশনিসংকেত।
উপজেলা বিএনপির সেক্রেটারি আলী আকবর বলেন, ‘রাজনৈতিক মোকাবিলা নয় বরং দল-মত নির্বিশেষে সামাজিক আন্দোলনে মাদকের বিরুদ্ধে প্রশাসনকে সহযোগিতা করাই সবার উচিত। কারণ এটা সামাজিক ব্যধি তাই মাদকাসক্তসহ জড়িতদের সামাজিক বয়কটের মাধ্যমে নির্মূলে সবাইকে এগিয়ে আসা উচিত।’
এ বিষয়ে উত্তর রণিখাই ইউ/পি চেয়ারম্যান মাস্টার ফয়জুর রহমান প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে উৎমা, দমদমা, বরমসিদ্দিপুর সীমান্ত দিয়ে মাত্রাতিরিক্ত মাদক নামছে স্বীকার করে বলেন, ‘চোঁখ মেললেই দেখি এলাকার প্রচুর সংখ্যক মানুষ মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে। ইউনিয়ন পরিষদের আহবানে শীঘ্রই সকল ওয়ার্ড মেম্বার, সচেতন নাগরিক সমাজ নিয়ে মাদক প্রতিরোধে করণীয় শীর্ষক আলোচনায় বসবো। তাছাড়া বিষয়টি দমনে উপজেলা আইন শৃঙ্খলা কমিটির সভায় অতীতের ন্যায় ফের উত্তাপন করবো।’
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. রবিন মিয়া বলেন, ঘনঘন অভিযানে পুলিশ প্রশাসন মাদকের চালান আটক করছেন। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে। প্রতিবেদকের এক প্রশ্নের জবাবে স্থানীয় নির্ভরযোগ্য সূত্রে মাদক ব্যবসায় যে বা যারা জড়িত তাদের তালিকা ওসি কোম্পানীগঞ্জ বরাবর জমা দেয়ার পরামর্শ দেন। এতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগণ ও মাদক নির্মূলে সামাজিক গণ আন্দোলন জোরদার করার আহবান জানান।
এ বিষয়ে, অফিসার ইনচার্জ রতন শেখ পিপিএম জানান, ঘনঘন অভিযানে মাদকের বিপুল চালান আটক করে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। তিনি আশংকাজনক হারে মাদকদ্রব্যের উৎপাতের খবর পাচ্ছেন তবে মাদকদ্রব্য সহ যাদের আটক করা যাচ্ছে তাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। তিনি এলাকাভিত্তিক স্থানীয় নাগরিকদের কঠোর সাহসী ভূমিকা রেখে সামাজিক আন্দোলন ও জোরদার করার ব্যাপারে অভিমত ব্যক্ত করেন। শতাধিক মাদক কারবারিদের নামের তালিকা প্রতিবেদনে উল্লেখ করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার বিষয়ে স্থানীয় দের আইনীভাবে সহযোগিতার পরামর্শ দেন।
সম্পাদক : জে.এ কাজল খান
স্বত্ত্ব: দৈনিক বিজয়ের কণ্ঠ (প্রিন্ট ভার্সন)
০১৭১৮৩২৩২৩৯
Design and developed by Yellow Host