কুশিয়ারার বুকে ‘বালু লুট’
শাল্লায় ভয়াবহ নদীভাঙনের নেপথ্যে অবৈধ ড্রেজার চক্র

প্রকাশিত: ৮:৩৯ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২৩, ২০২৫

<span style='color:#077D05;font-size:19px;'>কুশিয়ারার বুকে ‘বালু লুট’</span> <br/> শাল্লায় ভয়াবহ নদীভাঙনের নেপথ্যে অবৈধ ড্রেজার চক্র

তৌফিকুর রহমান তাহের, সুনামগঞ্জ
সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলা লাগোয়া কুশিয়ারা নদীর তীরবর্তী অঞ্চলগুলোতে ভয়াবহ নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। এর মধ্যেও ফয়েজুল্লাহপুর ও মার্কুলি বাজারের মধ্যবর্তী স্থানে দিনে-রাতে চলছে পরিবেশ ধ্বংসকারী অবৈধ বালু উত্তোলন। স্থানীয়দের অভিযোগের তীর সরাসরি মার্কুলি নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির দিকেÑতাদের প্রত্যক্ষ যোগসাজশেই চলছে এই ‘বিটবালু লুট’, যা নদীভাঙনকে আরও তীব্র করে তুলছে।

বর্ষার পর থেকেই শাল্লা থেকে আকিল-শা বাজার পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় নদী অস্বাভাবিকভাবে পাড় ভাঙতে শুরু করেছে। শত শত বসতভিটা ও ফসলি জমি বিলীন হওয়ার ঝুঁকিতে থাকা সত্ত্বেও, ভাঙন কবলিত এলাকার মাত্র ১ কিলোমিটার দূরত্বে ফয়েজুল্লাহপুর ও মার্কুলি বাজারের ঠিক মাঝখানে দুটি বৃহৎ ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন চলছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, প্রভাবশালী মঈনউদ্দীন মেম্বারের যোগসাজশে একটি চক্র দিনে-রাতে এই ড্রেজারগুলো পরিচালনা করে দৈনিক লক্ষ লক্ষ টাকার বিটবালু উত্তোলন ও বিক্রি করছে। নদীগর্ভ থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালু তোলায় নদীর গভীরতা ও স্রোতের গতিপথ বদলে যাচ্ছে, যা নদীভাঙনকে সরাসরি প্রভাবিত করছে।

অবৈধ বালু উত্তোলনকে কেন্দ্র করে স্থানীয় প্রভাবশালীরা একে অপরের ওপর দোষারোপ করছেন।মঈনউদ্দীন মেম্বার প্রভাবশালী মোতাহার আলীকে দোষারোপ করে বলেন, ‘বিগত দিনেও মোতাহার নদী থেকে বালু উত্তোলন করে আসছে। আমি তাকে গভীর রাতেও ড্রেজার চালিত নৌকার সামনে দেখতে পাই।’
তবে পরক্ষণেই তিনি প্রতিবেদককে ফোন করে সোহেল নামের আরেকজনকে এই চক্রের সাথে জড়িত বলে উল্লেখ করেন এবং সংবাদ প্রকাশ না করার জন্য অনুরোধ জানান।

অন্যদিকে মোতাহার আলী অবৈধ বালু উত্তোলনে নিজের জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘নদীতে ড্রেজার চলে এই বিষয়টা আমি থানাতেও জানাইছি। পূর্বে একসময় করছিলাম, এতে আমি সাজাপ্রাপ্ত হয়ে জেল খেটে আইছি। এখন নদীতে মঈনউদ্দীন মেম্বার, ফজল আর মিঠু প্রতিদিন ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করে।’
তিনি আরও অভিযোগ করেন, পুলিশ প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা সত্ত্বেও তিনি শাল্লা থানায় বিচারপ্রার্থী হয়েছেন।

মোতাহার আলীর অভিযোগ, পুলিশের এএসআই তারেক নাজিরে নেতৃত্বে ৫/৬ জন পুলিশ এসে একবার ড্রেজারসহ অভিযুক্তদের হাতকড়া লাগিয়েও রহস্যজনকভাবে ছেড়ে দেয়। তিনি মার্কুলি নৌ-পুলিশ ফাঁড়িতে যোগাযোগ করেও কোনো সহযোগিতা পাননি এবং একজন স্থানীয় সাংবাদিকও এই চক্রের সঙ্গে জড়িত বলে দাবি করেন।

ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামবাসীর প্রধান অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দু হলো মার্কুলি নৌ-পুলিশ ফাঁড়ি। ড্রেজারগুলো ফাঁড়ি থেকে সামান্য দূরত্বে প্রকাশ্যে চললেও নৌ-পুলিশের রহস্যজনক নীরবতা স্থানীয়দের ক্ষোভ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

এক স্থানীয় বাসিন্দা ক্ষোভের সঙ্গে জানান, ‘আমরা দিনের পর দিন ভাঙনের ভয়ে থাকি। আর মাত্র এক কি:মি দূরেই পুলিশ ফাঁড়ি থেকে চোখের সামনে নদীটাকে মেরে ফেলা হচ্ছে। আমরা নিশ্চিত, মার্কুলি নৌ-পুলিশের সঙ্গে এই লুটেরাদের সরাসরি বোঝাপড়া আছে। না হলে এতটা সাহস পায় কী করে?’ নদীভাঙনের শিকার শত শত পরিবার ক্ষতির সম্মুখীন হলেও পুলিশ প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তায় জনমনে তীব্র অসন্তোষ বিরাজ করছে।

পরিবেশবিদরা বলছেন, কুশিয়ারা একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী, যা জীববৈচিত্র্য ও কৃষির জন্য অপরিহার্য। এভাবে অবাধে বালু উত্তোলন চলতে থাকলে নদীর প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে। তাদের মতে, এটি কেবল নদীভাঙন নয়, পুরো হাওর অঞ্চলের পরিবেশ ও জনজীবনের উপর দীর্ঘমেয়াদী বিরূপ প্রভাব ফেলবে।

শাল্লা থানার অফিসার ইনচার্জ বলেন, অবৈধ বালু উত্তোলন এবং নদীভাঙন রোধে স্থানীয় প্রশাসনকে দ্রুত কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী। তারা প্রত্যাশা করছেন, পুলিশ প্রশাসনের যোগসাজশের অভিযোগ তদন্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং অবৈধ ড্রেজিং অবিলম্বে বন্ধ করা হবে।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

সর্বশেষ ২৪ খবর