ঢাকা ৫ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১২:১৮ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ১৭, ২০২৫
নবাব খান
আজ অনেকদিন পর পুরনো ডাইরিটা হাতে নিলাম এবং সেখানে তোমার একটি পুরনো অর্ধছেড়া ছবি দেখতে পেলাম । ধীরে ধীরে ডাইরিটি পড়তে শুরু করলাম। সেই অতীত সেই ২০১৫ সাল। অতীতের সেই কিশোর বয়সের ভালোবাসা । যতদূর মনে পড়ে মাধ্যমিক দেওয়ার আগেই তোমার প্রেমে পড়েছিলাম। হঠাৎ করেই একদিন আমার চোখের সামনে তুমি এলে, দেখে আমার মনে হল এ যেন এক পরী। তোমার হরিণী চোখের চাহনি সত্যি আমাকে মুগ্ধ করেছিল। সেই থেকে আজও পর্যন্ত তোমাকে বলতে পারিনি। দেখতে দেখতে মাধ্যমিক শেষ হলো স্কুল জীবন পেরিয়ে কলেজে পা রাখলাম। কলেজের প্রথম বসে থাকাকালীন প্রথম তোমার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম “ভালবাসি তোমাকে”। সাথে সাথে তোমার উত্তর ছিল এই যে, ‘আমি কোন সম্পর্কে জড়াতে চাই না’ । এক বাক্যে তোমার উত্তর শুনে চলে এসেছিলাম। এরপর থেকে আজও পর্যন্ত কখনো আর চিরচেনা এই স্কুলে আর পা রাখিনি। আমার মনের কোণে তোমার জন্য জায়গাটা এখনো একই আছে। কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে এসে জানতে পারলাম তুমি একটি সম্পর্কে জড়িয়েছো । যেটি আমার হৃদয়কে ভেঙে অনেক টুকরো করে দিয়েছিল। আমার হৃদয়টা এতটাই ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল যার দাগ আছে শুকায়নি। কিন্তু রাস্তায় তোমার সাথে তাকে দেখতে পেলাম। মনে হয় কোচিং থেকে একসাথে হেঁটে বাসায় ফিরছো । সে তোমাকে তোমার বাসার সামনে দিয়ে নিজের বাসার দিকে রওনা হল সম্ভবত। মনের কোণে হাজারো কষ্ট দেওয়া হলো। তারপরও নিজেকে শান্ত করলাম । আমার সাথে আমার অনেকগুলো বন্ধু ছিল। তারা আমাকে বলছিল তোমাকে কিছু বলার জন্য, আমি শুধু বলেছিলাম “কোন অধিকারের বললো ? যে আমার নয়, যে আজ অন্য কারো তার উপর আমার কি অধিকার আছে!” দেখতে দেখতে কলেজ জীবন শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। সেখানে এসে আরো অনেক নতুন অনেক বন্ধুবান্ধব পেলাম। সেখানে একদিন চায়ের আড্ডায় আমার এক বন্ধু সৈকত আমাকে জিজ্ঞেস করল, “তুই তো ভালোবাসা নিয়ে অনেক গল্প কবিতা লিখেছিস, তা এসব কার জন্য লিখেছিস বন্ধু ? প্রেমিকার জন্য” ? আমি উত্তরে বললাম, “লিখেছি কেউ একজনের জন্য যাকে আমি আজও একতরফা ভালোবাসি। এখনো যার প্রতি আমার অসম্ভব ভালবাসা রয়েছে। এখনো তাকে আমি প্রতিদিন কল্পনা করি, কিন্তু তাকে আমি কোনদিন পাইনি, পাবো না” । সৈকত বললো, বর্তমান যুগে এমন ভালবাসা হয় বেটা ? আমি বললাম, “ভালোবাসার মতো ভালোবাসা সব যুগেই হয়েছে, হয়। সেটার ৯০ দশক হোক কিংবা বর্তমান। হতে পারে বর্তমানে সত্যিকারের ভালবাসা পাওয়া দুর্লভ তবে অসম্ভব নয়”। সে বলল, “তাই বলে একতরফা? যেখানে পাওয়ার সম্ভাবনা শূন্য, সেখানে চাওয়াটা কি ভুল নয়” ? উত্তরে আমি বললাম, “ভালবাসলেই যে তাকে পেতে হবে বিষয়টা এমন নয়, ভালোবাসা মানে দূর থেকেও তার ভালো চাওয়া, তাকে অনুভব করতে করা। অনেক ভালোবাসা দূর থেকেই সুন্দর” । সৈকত বলল “সে কি জানে তাকে এতটা ভালবাসিস” ? আমি উত্তরে বললাম, “না, সে কিভাবে জানবে ? কলেজ জীবনের পর তার সাথে আর কখনো যোগাযোগ হয়নি। তার জীবনে এখন অন্য কেউ আছে। হয়তো ছেলেটি আমার থেকে বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন তাই তার ভালোবাসা ও বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছে । কিন্তু আজও প্রতিনিয়ত আমি কোন না কোন মাধ্যমে মেয়েটির খোঁজ খবর নিয়ে থাকি”। কাছে থেকে হঠাৎ বন্ধু সাবুল বলে উঠলো, বন্ধু এতো বর্তমান যুগের “রোমিও জুলিয়েট । একটি মেয়ে, যার প্রেমিক আছে। যার সাথে তোর কখনো প্রেম ছিল না এমনকি যে তোর জীবনেও নেই, তার জন্য কেন মনের ভিতর ভালোবাসা পুষে রেখেছিস” ? আমি উত্তরে বললাম ”ভালোবাসার কি কোনো কারণ হতে পারে”! কাছে থেকে মৌ হঠাৎ বলল, ”এ ভালোবাসা শুধু তোকে কষ্টই দিয়ে যাবে। তার থেকে বিশ্ববিদ্যালয় কাউকে পছন্দ কর, আমরা তোকে সমর্থন করবো”। আমি উত্তরে বললাম, “ভালোবাসা এটা নয়, আজ একজনের প্রতি অনুভূতি তৈরি হল, কাল আরেকজনের প্রতি। ভালোবাসা মানে একজনকেই ভালোবাসবো, একজনকে চাইবো”। খানিকক্ষণ পর আমি আবারো বললাম, “যাইহোক, এসব কথা এখন বাদ দে, বলো কার কি করার ইচ্ছা আছে” ? সবাই যার যার মনের ইচ্ছা ব্যক্ত করল। সবশেষ আমি বললাম আমার একজন ব্যারিস্টার হওয়ার ইচ্ছা ভবিষ্যতে। সেদিনের মতো এখানেই আড্ডা শেষ হয়ে গেল। কিছুদিন পরেই শুরু হলো ভয়াবহ করোনা মহামারী। বন্ধ হয়ে গেল স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। সারা দেশ যখন স্তব্ধ তখন পেলে লাগলাম একের পর এক মৃত্যুর সংবাদ। মনে হল দেশ একটি মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে । কিছুদিন পর বাবাকে হারালাম। মনে হলো জীবনের সব স্বপ্ন যেন মুহূর্তেই ধ্বংস হয়ে গেছে। তারপর পরিবারের দিকে তাকিয়ে নিজেকে শক্ত রাখলাম। কিন্তু কখনো দেশের পরিস্থিতি ঠিক হয়নি। তবে লকডাউন পরবর্তী সময়ে স্বল্প পরিসরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া সবকিছুই খুলেছে। তখন একদিন মৌ বলল, “অনেক বন্ধুকে দেখছি বিদেশের প্রতি আগ্রহী হচ্ছে। চল আমরা একবার আইএলটিএস দিয়ে দেখি, যদি ফলাফল ভালো হয় তাহলে ভবিষ্যতে কিছু একটা করা যাবে”। আমি বললাম “ঠিক আছে”। যদি মাকে ছেড়ে আমার দেশের বাইরে যাওয়ার বিন্দুমাত্র কোন ইচ্ছে নেই, তারপরও বন্ধুদের সাথে ভর্তি হলাম। কিন্তু কিছুতেই সেখানে আমার মন বসাতে পারলাম না। কিছুদিন পর একজন স্যারের সাথে দেখা হল। আল্লাহর রহমতে স্যারের অনুপ্রেরণায় ভালোভাবে পড়াশোনা শুরু করলাম। অবশেষে চার মাস পর পরীক্ষা দিলাম। সবার পরীক্ষায় আল্লাহর রহমতে খুবই ভালো হলো। পরিবার থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল উচ্চ শিক্ষার জন্য বাইরে যাব।
আমি, মৌ ও সাবুল তিনজনই সমসাময়িক সময়ে লন্ডন চলে আসলাম। সাবুল ও মৌ দীর্ঘদিন থেকে সম্পর্কে ছিল। অনেক জটিলতার পর তাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পেল, তারা বিয়ে করে নিল। সময়ের সাথে সাথে আমরা লন্ডনে উচ্চশিক্ষা সম্পূর্ণ করলাম। স্নাতক সম্পূর্ণ করার পর আমি জজকোর্টে প্র্যাকটিস করতে লাগলাম। সময় যেতেই থাকলো কিন্তু আমার মনে সেই মেয়েটি রয়ে গেল। হঠাৎ মনে হল দীর্ঘ ১০ বছর তার সাথে আমার কোন যোগাযোগ নেই । ফেসবুকে এই নামের একটি আইডির সামনে এলো। মনের অজান্তেই তাকে রিকুয়েস্ট পাঠালাম। সেও একসেপ্ট করে নিল । কিছু সময় পর বুঝলাম এটি সেই মেয়েটির আইডি। একদিন তার একটি শাড়ি পরা ছবি দেখলাম। আমার দেখে মনে হল মায়াবতী, যার মধ্যে অসম্ভব মায়া রয়েছে। তার মধ্যে মুগ্ধতার এতটাই জাদু রয়েছে যে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি। নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তার সম্পর্কের কথা। নাকি উত্তরে বললো, “তার বিচ্ছেদ হয়েছে অনেকদিন হলো”। কিছুদিন পর আমি তাকে আবার প্রস্তাব দিলাম কিন্তু সে প্রতিবারের মতো আমার প্রস্তাব প্রত্যাহার করল। এর অনেকদিন পর মৌ ও সাকিবের সাথে কথা হল। মৌ বলল, ”মেয়েটি কি জাদু করেছে তোকে বলতো ? আজও এত বছর পর এই মেয়েটিকে নিয়ে পড়ে আছিস”। আমি উত্তর বললাম, “এ ভালোবাসার গভীরতা তুই অনুভব করতে পারবি না”। মৌ বলল, “মেয়েটিকে দেখার খুব ইচ্ছা রইলো। আইডি টা দেয়া যাবে” ? আমি আইডি দিলাম এবং বললাম কখনো তাকে আমার কথা বলবি না। সে বলল “ঠিক আছে” । আর কিছুদিন পর মেয়েটির সাথে আবারও আমার কথা হল জানতে পারলাম মৌ সাথে কথা বলেছিল। মেয়েটি যেমন মায়াবতী তেমন রাগী। একসময় তার রাগী মনে আমার অল্প জায়গা হলো। তার সাথে ইনবক্সে অল্প পরিসরে কথা শুরু হলো। ভেবেছিলাম তার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবো। কিন্তু তার সাথে কথা বলার কয়েকদিনের মাথায় হঠাৎ রোড এক্সিডেন্টের সম্মুখীন হলাম আমি। হাসপাতলে ভর্তি করা হলো আমাকে। ডাক্তাররা আমাকে জানালো আপনার পা গুরুতর আঘাত পেয়েছে। হয়তো আপনাকে আপনার একটি পা হারাতে হতে পারে। একথা শুনে নিজের সব ইচ্ছা আকাক্সক্ষা এক মুহূর্তেই শেষ হয়ে গেল। এই পরিস্থিতিতে না নিজের পরিবারকে বলার মত কোন কথা ছিল না সেই মেয়েটিকে বলার মত কোন কথা ছিল। সব শেষ নিজেকে শান্ত করলাম, কিভাবে এই পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া যায় তা চিন্তা করলাম।
বারবার এই মেয়েটির কথা আমার মনে হলো। আমার এই পঙ্গু জীবনের সাথে তার এই সুন্দর জীবন জড়িয়ে তাকে আমি কষ্ট দিতে চাই না, কেননা তাকে যে আমি বড্ড ভালোবাসি। আমি চাইনা আমাকে নিয়ে সারাটা জীবন সে কষ্ট করুক, সে সুখী হোক তার জীবনে আমি এটাই চাই। অপরদিকে আমার এই পরিস্থিতিতে কখনোই তার পরিবার আমাকে মেনে নেবে না। আমি জানতাম মেয়েটির মন খুবই সুন্দর হলেও সে রাগী। তাই মেয়েটিকে আরো রাগানোর চেষ্টা করলাম। আমার নিজেরও অসম্ভব কষ্ট হলো সেই সময়। আমি কখনোই চাইনি মেয়েটিকে আমার জীবন থেকে চলে যেতে দিতে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে আমারও আর কোন কিছু করার নেই। তার সাথে যদি আমার প্রতিদিন কথা হয় একসময় অবশ্যই সে আমার ভালবেসে ফেলবে।আর আমি মেয়েটিকে এতটাই ভালবাসি যে আমার এই কষ্টের জীবনে তাকে আমি শামিল করতে চাই না। তাই মেয়েটিকে আমি আরো উল্টাপাল্টা কথা বলে রাগিয়ে দিলাম। তাকে এমন কিছু বললাম যে আমার বলা উচিত নয়। একপর্যায়ে তার রাগ এতটাই বেড়ে গেল যে সে আমাকে ব্লক করে দিয়ে চলে গেল। আমি আমার ফোনের দিকে তাকিয়ে দুই ঘন্টা শুধু কাদলাম। কি জীবন আমার! যার জন্য এত বছর অপেক্ষা করলাম, এত ভালোবাসলাম তাকে আজ আমার ছেড়ে দিতে হলো । তবে আমার এই জীবন থেকে তাকে মুক্তি দিতে পেরেছি এটি বড় কথা। আমার এই পঙ্গু জীবনে আমি চাইনা সে আজীবন আমার সাথে থেকে কষ্ট পেয়ে পেয়ে বাঁচুক। আমি চেয়েছি সে যেন তার স্বপ্ন তার ইচ্ছা পূরণ করতে পারে। তাই নিজস্ব ইচ্ছায় তাকে যেতে দিলাম। মনে হয় না কোন মানুষই চাইবে তার ভালোবাসার মানুষ তার কাছে এসে কষ্ট পাক, মাথায় সব কষ্ট নিজের বুকে লালন করেন আমি শুধু তার চলে যাওয়াটাই দেখলাম। হঠাৎ করে ঘড়িতে অ্যালার্ম বাজলো রাত বারোটা বেজেছে। ঘড়ির শব্দে অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে আসলাম। দেখি চোখ থেকে পানি পড়ে ডায়েরী টা পুরো ভিজে গেছে। আবারো অত যত্ন সহকারে ডায়েরিটি তার জায়গায় রেখে বিছানায় গেলাম । মনে হলো দীর্ঘ অনেক বছর পেরিয়ে গেল তার সাথে আর যোগাযোগ হলো না। ২০১৫ থেকে আজো পর্যন্ত তাকে ভুলতে পারলাম না, ভুলতে চাইও না। মনে অনেক প্রশ্ন জাগলো হয়তো সে আজ কারো সংসার করছে, হয়তো সে সুখী অনেক সুখী। যতটা সুখে হলে আমাকে আর কখনো তার মনে পরবে না। মনে পড়ার কোন কারণও নেই। তবে তাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে, তার কন্ঠটা খুব শুনতে ইচ্ছা করে। যাইহোক, সে বেঁচে থাকুক আমার ভালোবাসা, আমার মনে, আমার হৃদয়ে আজীবন।
সম্পাদক : জে.এ কাজল খান
স্বত্ত্ব: দৈনিক বিজয়ের কণ্ঠ (প্রিন্ট ভার্সন)
০১৭১৮৩২৩২৩৯
Design and developed by Yellow Host