প্রস্তাবিত বাজেট : প্রত্যাশা, বাস্তবতা ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ

প্রকাশিত: ৬:২০ অপরাহ্ণ, জুন ৪, ২০২৫

প্রস্তাবিত বাজেট : প্রত্যাশা, বাস্তবতা ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ

মো. আব্দুল বাসিত
উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ বৈঠকে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৮৯ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকার বাজেট অনুমোদন করা হয়েছে। যদিও এবারের বাজেট আগের বছরের চেয়ে ৭ হাজার কোটি টাকা কম। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ছিল ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথমবার আগের বছরের তুলনায় ছোট বা কম আকারের বাজেট উপস্থাপন হলো এবার। প্রস্তাবিত বাজেটের মোট জিডিপির ৯ শতাংশ আসবে রাজস্ব আয় থেকে। সরকার এটিকে জনমুখী ও উন্নয়নকেন্দ্রিক বাজেট হিসেবে উপস্থাপন করেছে। তবে সমসাময়িক অর্থনৈতিক বাস্তবতা, বৈশ্বিক সংকট ও অভ্যন্তরীণ চাপের প্রেক্ষাপটে এই বাজেট কতটা বাস্তবসম্মত—সেটি নিয়ে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি অর্থনীতিবিদদের মাঝেও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
এই বাজেট এমন এক সময়ে প্রণয়ন করা হয়েছে, যখন মূল্যস্ফীতি দীর্ঘদিন ধরে দুই অঙ্কে ঘোরাফেরা করছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাপের মুখে, এবং ব্যাংক খাত তারল্য সংকটে। এ পরিস্থিতিতে প্রায় ২ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘাটতি কতটা দক্ষতার সঙ্গে পূরণ করা সম্ভব হবে, সেটিই এখন বড় প্রশ্ন। সরকার অভ্যন্তরীণ ঋণ ও বৈদেশিক সহায়তার মাধ্যমে এই ঘাটতি মেটানোর কথা বললেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন হতে পারে।
বাজেটে পরিবহন ও জ্বালানি খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। মেগা প্রকল্পে সরকারের আগ্রহ স্বাভাবিক, তবে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো মৌলিক খাতে তুলনামূলকভাবে কম বরাদ্দ সমাজে দীর্ঘমেয়াদি অসাম্য তৈরি করতে পারে। উন্নত ভবিষ্যতের জন্য অবকাঠামো জরুরি হলেও, সেই ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজন দক্ষ জনশক্তি। আর সেটি গড়ে ওঠে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মাধ্যমে। তাই মানবসম্পদ উন্নয়নের দিকটি আরও গুরুত্ব পেলে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা কিছুটা হলেও পূরণ হতো।
অন্যদিকে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর কথা বলা হলেও বাস্তবে সেই বরাদ্দ কীভাবে বাস্তবায়িত হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। বিগত বছরগুলোতে এই খাতে অনিয়ম, তালিকা তৈরি নিয়ে পক্ষপাতিত্ব ও দেরি—এসবই সাধারণ মানুষের আস্থা কমিয়ে দিয়েছে। প্রকৃত দরিদ্ররা যেন এই বরাদ্দের সুফল পান, তা নিশ্চিত করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা উচ্চাকাঙ্ক্ষী হলেও কর কাঠামোতে মৌলিক সংস্কার দৃশ্যমান নয়। করজালের পরিধি বাড়ানো ছাড়া রাজস্ব প্রবৃদ্ধি সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে শুধু মধ্যবিত্তের ওপর করের চাপ না বাড়িয়ে ধনীদের কর ফাঁকি রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। একই সঙ্গে কর আদায়ে স্বচ্ছতা ও ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো দরকার।
এই বাজেটের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে এর বাস্তবায়ন। প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি ও গুণগত মান, প্রশাসনিক দুর্নীতি, এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা—এই তিনটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করবে বাজেটের কার্যকারিতা। শুধু বড় অঙ্কের ঘোষণা দিয়ে সাধারণ মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন সম্ভব নয়। বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দৃঢ়তা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত না হলে এটি কাগুজে হিসাবেই থেকে যাবে।
এই সময়ে মানুষ আশা করছে এমন একটি বাজেট, যার প্রতিফলন তারা বাজারে, হাসপাতালে, স্কুলে ও চাকরির বাজারে দেখতে পাবে। কাগজে নয়, বাস্তবে যে বাজেট মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনে—সেই বাজেটই সফল বাজেট।
লেখক : পোস্টাল অপারেটর, সিলেট বিভাগ।

সর্বশেষ ২৪ খবর