ঢাকা ২৬শে আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১১ই ভাদ্র, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৭:০১ অপরাহ্ণ, জুন ৪, ২০২৫
মুহাম্মদ আবদুল হামিদ
আজহা শব্দের অর্থ ত্যাগ। আর ঈদ শব্দের অর্থ উৎসব। ঈদুল আজহা শব্দের অর্থ ত্যাগের উৎসব। ‘কুরবানি’ অর্থ হলো ‘নৈকট্য’ বা ‘ত্যাগ-তিতিক্ষা’। ‘কুরবানী’ ঐ মাধ্যমকে বলা হয়, যার দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ হয়। আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে ঈদুল আজহায় যে পশু যবাই করা হয় তাকে ‘কুরবানী’ বলা হয়’। কুরবানির মাধ্যমে মুসলমানরা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে এবং জীবনকে পরিশুদ্ধ করে। কুরবানির বিধান যুগে যুগে সব শরিয়তেই বিদ্যমান ছিল। পৃথিবীর সব জাতি ও সম্প্রদায় আল্লাহর দরবারে তার প্রিয় বস্তু উৎসর্গ করতেন। তবে তা আদায়ের পন্থা ছিল ভিন্ন ভিন্ন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্যে কুরবানির এক বিশেষ রীতি পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি, যেন তারা ওই সব পশুর ওপর আল্লাহর নাম নিতে পারে, যা আল্লাহ তাদেরকে দান করেছেন।’ (সুরা হজ : আয়াত ৩৪)।
কুরবানীর উদ্দেশ্য :
কুরবানীর উদ্দেশ্য হলো, তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি অর্জন করা। আল্লাহ বলেন, ‘কুরবানীর পশুর গোশত বা রক্ত আল্লাহর নিকট পৌঁছে না; বরং তাঁর নিকট পৌঁছে কেবলমাত্র তোমাদের ‘তাক্বওয়া’ বা আল্লাহভীতি’। (সূরা হজ্জ, আয়াত ২২)। প্রিয় বস্তু বিসর্জনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। যেভাবে হযরত ইবরাহিম (আঃ) আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তাঁর নির্দেশ পালনার্থে একমাত্র সন্তান হযরত ইসমাইল (আঃ)-কে কুরবানীর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছিলেন।
কুরবানীর প্রচলন :
কুরবানির প্রচলন হজরত আদম আলাইহিস সালামের যুগ থেকে শুরু হলেও মুসলিম উম্মাহর কুরবানি মূলতঃ হজরত ইবরাহিম (আঃ) আল্লাহর সন্তুষ্টির পরীক্ষায় হজরত ইসমাইল (আঃ)-কে কুরবানির স্মৃতিময় ঘটনা থেকে। আল্লাহ তাআলা হজরত ইবরাহিম (আঃ)-কে তাঁর একমাত্র সন্তান হজরত ইসমাইল (আঃ)-কে কুরবানি করার নির্দেশ প্রদান করে কঠিন পরীক্ষায় ফেলেছিলেন। যা হজরত ইবরাহিম (আঃ) হাসিমুখে পালন করে আল্লাহর প্রেমের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। মুলত, তাঁদের এই ত্যাগের দৃষ্টান্তকে সমুজ্জল করে রাখার জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দুনিয়ার সামর্থবান মুসলমানদের জন্য বছরের নির্ধারিত দিনে নির্দিষ্ট জন্তু কুরবানী করাকে বিধিবদ্ধ করে দিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় প্রতি বছর ঈদুল আযহায় মুসলমানরা পশু জবাই করে আল্লাহর বিধান পালন করেন। স্মরণ করেন আল্লাহর প্রিয়বান্দা হযরত ইবরাহিম ও ইসমাঈল (আঃ)-কে। ত্যাগের এ উৎসবে মহান প্রভুর নির্দেশ পালন ও তাঁকে সন্তুষ্ট করার জন্য অসংখ্য অগণিত পশু জবাই করা হয় আল্লাহর নামে।
কুরবানী যাদের উপর ওয়াজিব :
প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থজ্ঞানসম্পন্ন সামর্থবান প্রত্যেক মুসলমান নারী-পুরুষের উপর কুরবানী করা ওয়াজিব। যদি তারা জিলহজ মাসের ১০ তারিখ ফজর থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়। সম্পদের মালিক হওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাক্তির টাকা-পয়সা, সোনা-রূপা, অলঙ্কার, প্রয়োজন অতিরিক্ত জমি বা বাড়ি, ব্যবসায়িক পণ্য ও অপ্রয়োজনীয় সকল আসবাবপত্র কুরবানীর নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য।
নিসাব পরিমাণ সম্পদ বলতে স্বর্ণের বেলায় সাড়ে সাত (৭.৫) ভরি আর রূপার বেলায় সাড়ে বায়ান্ন (৫২.৫) ভরি। এছাড়া টাকা-পয়সা ও অন্যান্য বস্তুর ক্ষেত্রে নিসাব হলো, সাড়ে বায়ান্ন ভরি রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হওয়া। পরিবারের একাধিক ব্যক্তির উপর কুরবানী ওয়াজিব হলে তাদের প্রত্যেকে কুরবানী আদায় করতে হবে।
কুরবানীর সময় :
জিলহজ মাসের ১০ তারিখ থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত কুরবানীর সময়। তবে সবচেয়ে উত্তম হল প্রথম দিন কুরবানী করা। এরপর দ্বিতীয় দিন এরপর তৃতীয় দিন। রাসূল (সা.) বলেছেন, ঈদের দিন আমরা প্রথমে নামায আদায় করি। অতপর ফিরে এসে কুরবানী করি। যে ব্যক্তি এভাবে আদায় করবে সে আমাদের নিয়ম মতো করল। আর যে নামাযের আগেই পশু জবাই করল সেটা তার পরিবারের জন্য গোশত হবে, এটা কুরবানী হবে না। (সহীহ মুসলিম)।
যেসব পশু দিয়ে কুরবানী করা যাবে :
উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা দ্বারা কুরবানী করা জায়েয। এসব গৃহপালিত পশু ছাড়া অন্যান্য পশু যেমন হরিণ, বন্যগরু ইত্যাদি দ্বারা কুরবানী করা জায়েয হবে না। তদ্রূপ হাঁস-মুরগি বা কোনো পাখি দ্বারাও কুরবানী হবে না। গরু-মহিষের বয়স দুই বছর, উঠের বয়স পাঁচ বছর, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বার বয়স কমপক্ষে এক বছর হতে হবে। একটি ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা দ্বারা শুধুমাত্র একজনই কুরবানী দিতে পারবে। এমন একটি পশু দুই বা ততোধিক ব্যক্তি মিলে কুরবানী করলে কারো কুরবানী শুদ্ধ হবে না। আর উট, গরু, মহিষে সর্বোচ্চ সাতজন শরীক হতে পারবে। সাতের অধিক শরীক হলে কারো কুরবানী বিশুদ্ধ হবে না।
কুরবানীর সামাজিক গুরুত্ব :
কুরবানী সামাজিক সমতা এবং সহানুভূতিপূর্ণ একটি ইবাদত। কুরবানীর পশু জবাই করার মাধ্যমে সৃষ্ট মাংস গরিব, আত্মীয়-স্বজন এবং পাড়া-প্রতিবেশীর মধ্যে বিতরণ করা হয়, যা সামাজিক বন্ধন এবং পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা বাড়ায়। প্রতি বছর শতকোটি টাকার কোরবানি হয়। এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক লেনদেন বৃদ্ধি পায়। কুরবানির পশু ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে ধনীদের সম্পদের কিছু অংশ দরিদ্র মানুষের কাছে পৌঁছে। কুরবানি করার পর পশুটিকে বিভিন্ন অংশে ভাগ করে, কিছু অংশ আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের মধ্যে এবং কিছু অংশ গরিব ও মিসকিনদের মাঝে বিতরণ করা হয়। এর মাধ্যমে ধনী-গরিবের মাঝে অনন্দ ভাগা-ভাগি করার সুযোগ তৈরী হয়।
কুরবানীর শিক্ষা :
কুরবানী আমাদেরকে তাক্বওয়া অর্জন, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ত্যাগ-বিসর্জন, ধৈর্য্যধারণ ও বিশুদ্ধ নিয়তের শিক্ষা দেয়। আল্লাহর জন্য নিজের জীবন বা সন্তানের জীবন উৎসর্গের প্রেরণা যোগায়। যেমনটি করেছিলেন হযরত ইবরাহিম (আঃ)। আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে তিনি তাঁর একমাত্র সন্তান হযরত ইসমাইল (আঃ)-কে কুরবানী করতে কোন্ঠাবোধ করেননি। আল কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, “(হে রাসূল!) আপনি বলুন, আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ (অর্থাৎ আমার সবকিছু) আল্লাহ রাববুল আলামীনের জন্য উৎসর্গিত।” (সূরা আনআম : ১৬২)।
এছাড়া কুরবানী আমাদেরকে সামাজিক সাম্য, উৎকৃষ্ট সম্পদ দান করা এবং উত্তম কাজের বেলায় কোন অজুহাত না খোজার এবং পশু জবাই করে কুরবানী করার মধ্যমে আল্লাহর জন্য নিজের সকল অবৈধ চাহিদা ও পশুত্বকে ত্যাগ ও কুরবানী করার শিক্ষা দেয়।
উপসংহার :
কুরবানি শুধুমাত্র একটি আনুষ্ঠানিক ইবাদত নয়, বরং এটি একটি গভীর আধ্যাত্মিক এবং সামাজিক শিক্ষা। এটি মানুষকে ত্যাগ, সহানুভূতি, এবং অন্যের প্রতি ভালোবাসা শিক্ষা দেয়। হযরত ইবরাহিম (আঃ) কর্তৃক পুত্র ইসমাঈল (আঃ)-কে কুরবানীর সেই আত্মত্যাগের শিক্ষা আর খোদাপ্রেমের অনুপম দৃষ্টান্ত অন্তরে ধারণ করে পশু যবাইয়ের সময় আমরা মনের কলুষতা, লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, ক্রোধ, স্বার্থপরতা, আন্তরের পশুচরিত্রকে দমনের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির প্রয়াস চালাবো। মুসলিম উম্মাহ ঈদুল আযহার ত্যাগের শিক্ষা, চেতনা ও আদর্শ লালন করে বিভেদ ভুলে ঐক্য ও সংহতি স্থাপন করে মিল্লাতের সোনালী যুগের আদর্শে নবচেতনায় উজ্জীবিত হয়ে উঠুক।
লেখক : প্রবন্ধকার, সিলেট।
সম্পাদক : জে.এ কাজল খান
স্বত্ত্ব: দৈনিক বিজয়ের কণ্ঠ (প্রিন্ট ভার্সন)
০১৭১৮৩২৩২৩৯
Design and developed by Yellow Host