শাবি শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবন : মানুষের বন্ধু হয়ে বাংলায় কথা বলবে রোবট ‘লি’

প্রকাশিত: ৫:০১ অপরাহ্ণ, মে ৩, ২০১৯

শাবি শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবন : মানুষের বন্ধু হয়ে বাংলায় কথা বলবে রোবট ‘লি’

নুরুল ইসলাম রুদ্র, শাবি
তিন বছর ধরে গবেষণা করে দুই পাঁয়ে হাঁটতে পারে এবং বাংলায় কথা বলতে পারে ‘লি’ নামের এমন রোবট তৈরী করেছেন সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী। ‘আমি বাংলায় কথা বলতে পারি হাঁটতেও পারি, আমার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে মানুষের উপকার করতে চাই।’ এভাবে বাংলা ভাষায় কথা বলতে শুরু করলেন সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের একদল গবেষকের তৈরী করা রোবট ‘লি’। তোমার দেশের নাম কি? বাংলাদেশের জাতির জনক কে? বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কে? কিংবা মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক যেকোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে রোবট ‘লি’। এমনকি মানুষের চেহারা মনে রাখতে পারে। কেউ তার সাথে করমর্দন করতে চাইলে সে করমর্দন করে, স্যালুট দেয়। এছাড়া নাচতে পারে সে গানের তালে তালে। কথা বলার সময় চোখের পলক ফেলে ঠোট দুটো নড়ে ওঠে তার। ‘লি’ এর উচ্চতা ৪ ফুট ১ ইঞ্চি (১২৬ সেমি) এবং ওজন ৩০ কেজি। এটি দেশের প্রথম পাঁয়ে হাটা রোবট বলে দাবি করছেন এর উদ্ভাবকবৃন্দ।

ওরা পাঁচজন : বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্রাইডে ল্যাবের পাঁচ শিক্ষার্থী তৈরী করেছে এ রোবট। এতে টিম লিডার হিসেবে ছিলেন বিশ^বিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২০০৯-১০ সেশনের শিক্ষার্থী ও নর্থ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সিইসি বিভাগের প্রভাষক নওশাদ সজীব। এছাড়া ছিলেন বিশ^বিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান রুপক, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের একই বর্ষের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলাম, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের মোহাম্মদ সামিউল ইসলাম ও জিনিয়া সুলতানা জ্যোতি। তাদের সাথে সার্বিক তত্বাবধায়নে ছিলেন জনপ্রিয় লেখক অধ্যাপক ড. জাফর ইকবাল।

রোবট লি’র বেড়ে ওঠার গল্প : ছেলেবেলা থেকে বিজ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা কাজ করতো। জাফর ইকবাল স্যারের বই পড়ে বিজ্ঞানকে আরো বেশি ভালোবেসে ফেললাম। বিশেষ করে স্যারের লেখা কল্পকাহিনিগুলো আমাকে বেশি অনুপ্রানিত করতো। অনেক আশা ছিলো ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের রোটিক্স অ্যান্ড মেক্যাট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পড়াশুনা করবো। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে সেখানে পড়ালেখার সুযোগ হয়নি। ভর্তি হলাম এই বিশ^বিদ্যালয়ের সিইসি বিভাগে। তখনও থেমে থাকেনি রোবট নিয়ে ভাবনা চিন্তার। রোবটনিয়ে আরো বই পড়তে শুরু করলাম। রোবটকে জানার আগ্রহটা আরো দ্বিগুন করে বাড়িয়ে দিলাম। পরে ২০১৩ সালে জাফর ইকবাল স্যারের সহযোগিতায় গঠন করি ‘রোবো সাস্ট’। প্রথম দিকে তেমন বেশি সদস্য না থাকলেও এখন এতে প্রায় দুইশত শিক্ষার্থী কাজ করে। রোবট নিয়ে আমাদের সাফল্য ‘সাস্টু ওয়ান’। ২০১৩ সালে আমরা এটি তৈরী করেছিলাম। প্রথমটির কার্যক্ষমতা বেশি না থাকায় পরবর্তীতে ২০১৫ সালে ‘সাস্টু ওয়ান’ এর চেয়েও বেশি কার্যক্ষমতা সম্পন্ন রোবট তৈরী করি। যার নাম ছিলো ‘রিবো’। ‘সাস্টু ওয়ান’ শুধু লিখতে পারতো। কিন্তু রিবো লেখার পাশাপাশি বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারতো। এরই ধারাবাহিকতায় দীর্ঘ তিন বছরের চেষ্টায় আমরা তৈরী করলাম ‘রোবট লি’। এভাবে রোবট তৈরীর গল্পের কথা বলতেছিলেন দলের প্রধান নওশাদ সজীব। তিনি কাজ করেছিলেন রোবোট লি এর অন্যতম প্রধান অংশ প্রোগ্রামিং নিয়ে। এর সাথে তিনি জাভা ও পাইথন নিয়ে কাজ করেছেন। রোবট লি এর অপারেটিং সিস্টেম হিসেবে ব্যবহার করা করেছেন ওপেন সোর্স উইন্ডো অপারেটিং সিস্টেম ভার্সন ১৮.৪। রোবট লি তৈরীর উদ্দেশ্যর কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের এ রোবট তৈরির মূল উদ্দেশ্য ছিল রোবটকে হাঁটা-চলা করানোর সঙ্গে সঙ্গে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা পরিচালনা করা।

নওশাদের সঙ্গে কথা জুড়ে দিলেন রোবটটির নীলনকশার কাজের দায়িত্বে থাকা মেহেদী হাসান রুপক। তিনি বলেন, লি এর মুখমন্ডলের নকশা করতে গিয়ে আমাদেরকে অনেক কাঠখোড়া পোহাতে হয়েছে। রোবট লি এর শারীরিক গঠনে আমরা অনেকটা মানুষের রুপ দিতে চেষ্টা করেছি। এর জন্য প্রথম দিকে তৈরী করা মুখমন্ডেলের নকশা ভালো হয়নি। কেমন যেনো কাটখোট্টা হয়ে যাচ্ছে। পরে আমরা জাফর ইকবাল স্যারের সাথে পরামর্শ করে রোবটের মুখমন্ডলের নকশার জন্য ফেইসবুকে একটা ইভেন্ট খুলি। তাতে অনেক সাড়া মিললেও সেসব নকশা আমাদের পছন্দ হয়নি। ফলে আমরা নিজেরাই আবার ডিজাইন শুরু করলাম। একসময় আমরা আমাদের কাঙ্খিত ডিজাইনের অনেকটা কাছাকাছি একটা ডিজাইন পেলাম এবং সেটাই লি এর জন্য সিলেক্ট করলাম।

ইলেকট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল সিস্টেমে কাজ করেছেন সাইফুল ইসলাম ও সামিউল হাসান। সাইফুল বলেন, ‘আমি রোবটির হাত, পায়ের বিভিন্ন জয়েন্ট, হাটা ও ভারসাম্য নিয়ে কাজ করেছি। আমাদের বিশ^বিদ্যালয়ের ল্যাবগুলোর যন্ত্রপাতি অনেক পুরোনো হওয়ায় সেগুলো তেমন শক্তিশালী ছিল না। ফলে শক্ত কোনো বস্তু ড্রিল করতে গিলে বিভিন্ন সময়ে তা ফসকে এসে আমাদের হাতে লাগতো।’ ‘আমাদের জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজ ছিলো রোবট তৈরীর জন্য যন্ত্রপাতি জোগাড় করা। এসব যন্ত্রপাতি জোগাড় করতে আমাদের প্রায় এক বছর সময় লেগে যায়। তবে আমরা সফলভাবে রোবট তৈরী করতে পেরেছি বলে আমাদের সকল দুঃখ-কষ্ট মুছে গেছে। এই সফলতার অনুভুতি মুখে বলে বোঝানো সম্ভব নয়’ বলে সঙ্গে যোগ করলেন সামিউল।

রোবটটিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও বাংলা ভাষা শিখিয়েছেন জিনিয়া সুলতানা জ্যোতি। তিনি বলেন, রোবটিতে আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংযুক্ত করেছি। ফলে রোবটটি বাংলাতে কথা বলার পাশাপাশি হাত-পা নাড়ানো ও অঙ্গভঙ্গিও করতে পারে। মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে এটি। এছাড়া রোবটটিকে গান, কবিতা ইত্যাদি শেখানো হয়েছে। সাধারণত বাসাবাড়ি ও অফিসে ব্যবহার করা হয় এমন সব ভাষা ‘লি’ কে শেখানো হয়েছে। এমন রোবট তৈরী করার কারণ জানাতেও ভুলেননি তারা।

সাইফুল ও সামিউল বলেন, মানুষের জীবন অতি মূল্যবান, বর্তমান ডিজিটাল বাংলাদেশে মানুষকে অনেক ছোটখাটো ঝুঁকিপূর্ণ এবং একঘেয়েমি মুলক কাজ করতে হয় যা যদি কোন যন্ত্র করে দিত তাহলে মানুষ উদ্ভাবনীমূলক কাজ করার আরও বেশি সময় পেত। শুধু সফটওয়্যার, অ্যাপ এক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়, মানুষের পরিবেশে এরকম কাজ করে দেয়ার জন্য বুদ্ধিমান যন্ত্র প্রয়োজন যেটা কিনা দেখলে শুধু একটা যন্ত্র মনে না হয়ে ফ্রেন্ডলি হবে এবং তাকে কমান্ড দেয়ার জন্য আলাদা কোন প্রস্তুতির প্রয়োজন হবে না। সোশ্যাল হিউম্যানয়েড রোবট এমন ই একটা যন্ত্র যা মানুষের পরিবেশে মানুষের ভাষা বুঝতে পারবে এবং ঝুঁকিপূর্ণ এবং মানুষের পক্ষে একঘেয়েমির কাজগুলো করতে সহায়তা করবে এমনটাই প্রত্যাশা করছেন উদ্ভাবকবৃন্দ।

‘আবার আসিয়াছি ফিরে, রোবট হয়ে এই বাংলায়’ ¯েøাগানে রোবটটির নামকরণ করেন বিশ^বিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী নাহিন সুলতানা। তিনি বলেন, ছোটবেলায় স্বরবর্ণ পড়ার সময় ‘লি’ নামে একটি বর্ণ পড়া হতো; যা দেখতে ৯-এর মতো ছিল। কিন্তু এর কোনো ব্যাবহার আমি দেখতাম না। তাই ভাবলাম, যদি এই রোবটির নামকরণের মধ্য দিয়ে বর্ণটিকে বাঁচিয়ে রাখা যায় তাহলে বর্ণটির ব্যবহার না হলেও এটি আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে যাবে না।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা : বাংলাদেশকে দক্ষ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন রোবট উপহার দিতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের রোবট ‘লি’ তৈরী করতে প্রায় ১০ লক্ষধিক টাকা লেগেছে। এখন আমরা নতুন কোনো রোবট তৈরি করতে চাইলে অবশ্যই রোবট লি এর চেয়েও ভালো মানের রোবট তৈরী করতে চেষ্টা করবো। এজন্য আমাদের প্রায় এক কোটি টাকা বা তার কাছাকছি অঙ্কের টাকা প্রয়োজন। কিন্তু এতো টাকা আমাদের পক্ষে জোগাড় করা সম্ভব নয়। তাই বাংলাদেশের আইসিটি ডিভিশন বা বাংলাদেশ সরকার যদি আমাদেরকে সহযোগিতা করেন তাহলে আমরা আরো ভালো মানের রোবট তৈরী করতে পারবো বলে আশা ব্যক্ত করেন দলেন প্রধান নওশাদ সজীব। বাজেটের কথা সঙ্গে আরো একটু কথা যোগ করে সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের তৈরী করা রোবট ‘লি’ আস্তে আস্তে হাঁটে। রোবটকে হাঁটানোর জন্য অনেক দামি মোটর প্রয়োজন। কিন্তু আমরা কম বাজেট পেয়েছি। আরও বাজেট পেলে উন্নত মানের রোবট তৈরি করতে পারবো।’

নিজেদের কাজের সফলতার কথা জানিয়ে জিনিয়া সুলতানা জ্যোতি বলেন, ‘আমরা এখন হিউম্যান রোবট তৈরী করতে জানি। রোবট তৈরী করা জন্য যেসকল উপাদান প্রয়োজন তা আমাদের জানা আছে। বর্তমানে বিশে^র অন্যতম একটি ইন্টিলিজেন্ট রোবট হচ্ছে ‘আমিসু’। যেটি এখন পর্যন্ত ভালোভাবে হাঁটতে পারে। এটি কিনতে গেলে প্রায় ২৫ কোটি টাকা খরচ হবে। আমাদেরকে যথেষ্ট সহযোগিতা করা হলে আমরা এমন রোবট তৈরি করতে পারবো।’

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

সর্বশেষ ২৪ খবর