ঢাকা ৫ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৩:২৫ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২০, ২০১৮
জৈন্তাপুর সংবাদদাতা
একটি পিচঢালা পথ চলে গেছে গ্রামের শেষ মাথায়। অনেক দূর অবধি চোখ ছুটে যাবে ফুটন্ত শাপলার গালিচা পেরিয়ে। দেখলে মনে হবে, স্বচ্ছ পানির উপরে লাল শাপলা ফুলের বড় এক প্রাকৃতিক স্বর্গ সৃষ্টি করে দাঁড়িয়ে আছে আপনার অপোয়। ফুটন্ত শাপলা ফুলের স্বর্গে নৌকায় আপনি ভেসে বেড়াচ্ছেন এপার থেকে ওপারে। লাল শাপলাগুলো আপনার নৌকা ঘেঁষে আপনাকে আগমনী শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। সেই শাপলাগুলো হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করা যাবে নিমিষেই। ভাবতেই ভালো লাগছে!
সিলেটের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত পান-পানি-নারী খ্যাত জৈন্তাপুর উপজেলা। এ উপজেলায় প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদে ভরপুর। মেঘালয়ের সবুজ পাহাড়ের পাদদেশ ঝর্ণা বেষ্টিত লাল শাপলার বিল নামে পরিচিত লাভ করে ডিবির হাওর। ৪টি বিলে প্রায় ৯ শত একর ভূমিতে প্রাকৃতিকভাবে লাল শাপলার জন্ম।
বিলগুলো হল- ডিবি, ইয়াম, হরফকাট ও কেন্দ্রীবিল। শরতের অসংখ্য লাল শাপলা প্রাকৃতিক সম্পদে পরিণত হয়েছে এ অঞ্চলের মানুষের জন্য। লাল শাপলা বিলে গেলে চোখে পড়বে লাল-সবুজের হাতছানি। লাল-সবুজের সমারোহ দেখে রীতিমতো অবাক হতে হবে আপনাকে। প্রকৃতির যেন নিজ হাতে সাজিয়ে তুলে লাল শাপলার বিল সমুহ। আগাছা আর লতাগুল্মে ভরা বিলের পানিতে ফুটে আছে হাজার হাজার লাল শাপলা। সূর্যে সোনালি আভা শাপলা পাতার ফাঁকে ফাঁকে পানিতে প্রতিফলিত হয়ে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে এই বিলের সৌন্দর্য্য। নৌকা কিংবা হাঁটুপানি মাড়িয়ে বিলের মধ্যে প্রবেশ করলে একপর্যায়ে মনে হবে শাপলার স্বর্গরাজ্যে বন্দী হয়ে গেছেন আপনি। মনে হবে মৃদু বাতাসের সাথে সাথে লাল শাপলা আপনাকে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। লাল শাপলার হাসি বিলজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে পরশমাখা ভালোবাসায়।
পৌরণিক ইতিহাস হতে জানা যায়- ব্রিটিশ শাসিত ভারত উপমহাদেশের শেষ স্বাধীন রাজ্য ছিল জৈন্তিয়া। শ্রীহট্ট তথা ভারত বর্ষের অধিকাংশ এলাকা যখন মোগল সার্মাজ্যভূক্ত ছিলো, তখনও জৈন্তিয়া তার পৃথক ঐতিহ্য রা করে আসছিল। প্রায় ৩৫ বছর স্বাধীন রাজ্য হিসাবে পরিচালিত হয়েছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের গ্রন্থ মহাভারত এবং রামায়নে জৈন্তিয়া রাজ্যের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ রয়েছে।
এতে উল্লেখ আছে, ১৭৯০ খ্রিষ্টাব্দ রাজা বিজয় সিংহের শাসনকালে জৈন্তিয়ায় খনিজ সম্পদে ভরপুর ছিল বর্তমানেও রয়েছে। রাজা বিজয় সিংহ ১৭৭৮ সালে সারিঘাট ঢুপি গ্রামে রামেশ্বর শিব মন্দির স্থাপন করেন। ১৮৩৫ সালের ১৬ মার্চ হ্যারি নামক ইংরেজ রাজেন্দ্র সিংহকে কৌশলে বন্ধি করে মূল্যবান সম্পদ লুট করে নেয়। আর ডিবির হাওর রাজা বিজয় সিংহের স্মৃতি বিজড়িত সমাধী স্থলেই লাল শাপলার বিলগুলো অবস্থিত। বিলের পারে বিজয় সিং-এর সমাধি পর্যটকদের এ যেন আরেক জানার কৌতুহল জাগিয়ে তুলে।
সূর্যদয়ের সাথে সাথে বেলা ১১টা পর্যন্ত লাল শাপলার সৌন্দর্য্য দৃশ্যমান থাকে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে শাপলাগুলো নিশ্চুপ নীরব হয়ে যায়। লাল শাপলার ফুটন্ত ফুল ডিবির হাওর আশ-পাশের পরিবেশকে মনোমুগ্ধকর করে তুলে। অপরূপ সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে ঘন কুয়াশা ও শীত উপো করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল জেলা ও উপজেলা থেকে দল বেধে ছুটে আসে অগণিত পর্যটক, ঢল নামে লাল শাপলার বিলে। বিলের লাল শাপলার ফুটন্ত ফুল যেন ভ্রমণ পিপাসু পর্যটকদের হাতছানি দিয়ে ডাকে। রয়েছে নানা প্রজাতির অতিথি পাখির কিচির মিচির সুর, যেন মনে হয় প্রকৃতি নিজে বাধ্য যন্ত্রের ধারা সুরের ঝর্ণা ধারা ছড়িয়ে দিচ্ছে।
ডিবির হাওরের বিলগুলো বিগত ২০১৪ সনে স্থানীয়, জাতীয় ও ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ার কল্যাণে বিলগুলো পর্যটকদের কাছে পরিচিতি লাভ করলে সম্প্রতি কিছু অসাধু ভূমি খেকোচক্র কুদৃষ্টি পড়ে লাল শাপলার বিলগুলোর জেগে ওঠা জমির দিকে। চক্রটি বিভিন্নভাবে দখলের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ৪টি বিলের মধ্যে হরফকাটা বিলটি সৌন্দর্য্য নষ্ট করে দিয়েছে। মহিষ নামিয়ে শাপলা ফুল ধ্বংস করে দেওয়া, শাপলার মূল উত্তোলন করে দেওয়ার ফলে বিলে শাপলা গাছ থাকলেও ফুল শূন্য হয়ে পড়েছে। ইজারানীতি অমান্য করে অসময়ে বিলের পানি শুকিয়ে শাপলার মূল ধ্বংস করার কারণে কেন্দ্রী বিলের সৌন্দর্যতাও নষ্ট করে দিয়েছে।
অপরদিকে স্থানীয় সামাজিক সংগঠন ও প্রকৃতি প্রেমীরা দাবী তুলেন, বাংলাদেশের বৃহত্তম হাওরের মধ্যে অন্যতম ডিবির হাওর, হরফকাটা, ইয়াম বিল ও কেন্দ্রী বিল। বিলগুলোর ইজারা বাতিল করা এবং বিল সমূহের ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন করে বন্ধোবস্তের অপচেষ্টা বন্ধ করা ও বাতিলের দাবী জানান।
বিলগুলো রার্থে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপা’র উদ্যোগে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার সিলেটে মানববন্ধন পালন করে। এছাড়া লাল শাপলা বাঁচাও আন্দোলন কমিটি ও জৈন্তিয়া পর্যটন উন্নয়ন ও সংরণ কমিটি লাল শাপলা বিলগুলোর লীজ বাতিল এবং পর্যটন কেন্দ্র ঘোষণার দাবী জানিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মৌরীন করিমের মাধ্যমে জেলা প্রশাসক বরাবরে পৃথক পৃথক স্মারকলিপি প্রদান করা হয়।
পর্যটকদের মতে, সিলেটের দর্শণীয় স্থান সমূহের তালিকায় হরিপুর গ্যাসফিল্ডের ৭নং গ্যাস কুপ, জৈন্তাপুর সাইট্রাস গবেষণা কেন্দ্রে, রাতারগুল, বিছনাকান্দি, মায়াবন, পান্থুমাই, মায়াবতী ঝর্ণা, বল্লার ঘাটের জমিদার বাড়ী, লালাখাল, শ্রীপুর চা-বাগান, জাফলং চা বাগান, দর্শণীয় স্থানগুলোর মধ্যে ডিবির হাওরের লাল শাপলার ৪টি ভি ও পর্যটকদের কাছে শীর্ষ স্থান দখল করে নিচ্ছে।
লাল শাপলার বিলে ভ্রমণে আসা পর্যটকরা জানান- লাল শাপলার বিলের পরিবেশ অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। স্বাধীন জৈন্তিয়া রাজ্যের রাজা বিজয় সিংহের সমাধিস্থল, বিলের পাশে খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য্য বিলটিকে আকর্ষণীয় করে তুলে ভ্রমণ পিপাসু ও পর্যটক প্রেমীদের আকর্ষিত করে। লাল শাপলার বিলগুলো লীজ বাতিল করে পর্যটন কেন্দ্র ঘোষণা করার দাবী জানান।
সম্পাদক : জে.এ কাজল খান
স্বত্ত্ব: দৈনিক বিজয়ের কণ্ঠ (প্রিন্ট ভার্সন)
০১৭১৮৩২৩২৩৯
Design and developed by Yellow Host